দশটি কালোমাণিক দশটি কালো হীরে,
একটি ঢোকে জল খেতে গিয়ে, দম
এলো না আর ফিরে।
নয়টি কালোমাণিক শুতে গেল রাতে
একটির ভাগ্যে এমন খারাপ, ভাঙ্গলো না
তার ঘুম প্রাতে।
আটটি কালো হীরে, বেড়ায় ঘুরে
পাহাড় পর্বতে,
একটি মাণিক হারিয়ে গেলো, রইলো–
মাত্র সাতে।
সাতটি কালোমাণিক কাঠ কাটতে
গেল বনে,
একটি কেটে দুখান হলো ঠেকলো
বাকী ছয়ে।
ছয়টি কালেহীরে মারলে ঢিল
মৌচাকে না ভেবে সাত পাঁচ,
হূলের বিষে একটি মলো হাতে
রইল কেবল পাঁচ,
পাঁচটি কালোমাণিক গেলো
আদালতে দিতে বিচারে মন,
একটি গেলো কারাগারে ফিরলো
বাকী চারজন।
চারটি কালোমাণিক সাগর-জলে
নাচে ধিন্ ধিন,
একটি গেলো সিন্ধু পাখীর
পেটে বাকী রইলো তিন।
তিনটি কালোমাণিক দেখতে
গেলো বনের পশুছানা,
একটি খেলো শ্বেতভাল্লুকে
ফিরলো দুটি কালোসোনা।
দুটি কালেহীরে রোদে গিয়ে
করে চিক চিক,
একটি কুঁকড়ে পাকায় তালগোল,
রইলো শুধু এক।
শেষ কালোমাণিক, শেষ প্রাণের
সোনা,
মনের দুঃখে দিলো (গলায়) দড়ি
রইলো না আর কেউ।
কালোমাণিকদের নিয়ে লেখা বিষাদে ভরা একটি কবিতা হ্যাঁ ঠিকইতো, ভুলেই গিয়েছিলাম দ্বীপটার নামও যে নিগার আইল্যাণ্ড। নিগার অর্থাৎ নিগ্রো। কালো নিগ্রোগুলোই তো কবির সেই দশটি কালো মাণিক, কালেহীরে, কালো সোনা। হ্যাঁ, এক একটি মাণিক, হীরে আর সোনাই বটে।
আবার জানলার পাশে ফিরে গিয়ে বসলো ভেরা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো নীল সমুদ্র। ঢেউ, ঢেউ এর পর ঢেউ, ফেনলি জলরাশি, বিরাট বিরাট মেঘের মতোন আছড়ে পড়ছে সমুদ্র-তীরে, ঢেউ ভাঙা জল ছড়িয়ে পড়ছে বালিয়াড়িতে। অপরাহ্নের শেষ আলোয় রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ে ঢেউগুলোর গায়ে। আর বিকেল যতো গড়িয়ে যেতে থাকে সেই রক্তিমাভা রক্ত-রঙে পরিণত হতে থাকে।
রক্ত! শুধু রক্ত! সেই রক্তের হোলিখেলায় ছোট ছোট মাথাগুলো কখনো ডুবছে, কখনো ভেসে উঠেছে, কখনো বা ভেসে উঠছে আবার ডুবছে, আবার ভাসছে–
না না এখন আর ওসব কথা নয়, ভেবে কোন লাভও নেই, সবই তো শেষে হয়ে গেছে কবেই।
পাকা টমাটোর মতো লাল সূর্যটা তখন দুরে, বহুদুরে সমুদ্রের ওপারে নেমে এসেছে, একটু পরেই টুপ করে ডুবে যাবে। ঠিক সেই সময় উঃ আর্মস্ট্রং প্রাসাদে এসে পৌঁছুলেন। নারাকট তার লঞ্চে পৌঁছে দিয়ে গেল তাঁকে।
দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে আসার সময় পরিশ্রম তার কম হয়নি। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ, অবসাদে চোখ দুটো বুজে আসছে, কপালের শিরা দপ দপ করছে। তা হোক গে, ক্লান্তি আমাকে গ্রাস করতে পারবে না। এই তো, আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠছি আবার, কিসের ক্লান্তি? ঐ যে ঐ সমুদ্র এমন একটা নির্জন পরিবেশ, ঠিক এমনিটিইতো আমি চেয়েছিলাম। মনেপ্রাণে। দীর্ঘ দিনের ছুটি, না বেশিদিন ছুটি নেওয়াটা ঠিক হবে না। আর্থিক ক্ষয় ক্ষতির থেকে আসল ক্ষতিটা অন্য। বেশিদিন চোখের আড়াল হয়ে তাকলে আজকাল মানুষজন আর মনে রাখতে চায় না, কেমন সহজেই ভুলে যায়। না, তা হলে চলবে কেমন করে? আমার খ্যাতি তো এখন সবে মধ্যাহ্ন গগনে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে এখনো অনেক দেরি।
তবে এসব খ্যাতি-ট্যাতির চিন্তা ছাড়তে হবে এখন চিরদিনের জন্যে। এখন ভেবে নিতে হবে, সব ছেড়ে-ছুঁড়েই আমি এখানে এসেছি, ফিরে আর যাবো না, কখনো না, কোনদিনই নয়। বিদায় বিদায় হারলি স্ট্রীট।…
এই দ্বীপ, এই নিগার আইল্যাণ্ড…যেদিকে তাকাই শুধু থৈ থৈ জল, জলের মাঝে ছোট একখানি সবুজ দ্বীপ শহর থেকে দূরে অনেক দূরে, মানুষের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, নিস্তব্ধ নির্জন একটি দ্বীপ, চিন্তা-বিহীন এক অখণ্ড অবসর যাপনের একটা নিশ্চিন্ত আস্তানা। এ যেন এক নতুন পৃথিবী, এই পৃথিবীর মধ্যেই আমার মনের মতোন একটা পৃথিবী। আমার সাধের এই পৃথিবী ছেড়ে আর কোন দিন ফেরার ইচ্ছা নেই।
কোন আকর্ষণই আমাকে ঘরমুখো করতে পারবে না, আমি আমার ঘরের চাবি ফিরিয়ে দিতে চাই। এখন ফিরিয়ে দিতে চাই সবকিছু। আমার ফেলে আসা পৃথিবীর প্রতি কোন আসক্তিই আর নেই। আমার আত্মীয় বন্ধুরা বলুন কে নেবেন আগের পৃথিবীতে ফেলে আসা আমার যথা সর্বস্ব। উত্তর দিন, এগিয়ে আসুন আপনাদের মধ্যে থেকে একজন কেউ..আমি সম্পূর্ণ মুক্ত হতে চাই, আমি আমার আমিত্ব ভুলে গিয়ে নতুন করে আবার এখানে জীবন শুরু করতে চাই।
খাঁচা-ছাঁড়া এক মুক্ত পাখী যেন আমি এখন। খুশি খুশি ভাব নিয়ে পাথরের ধাপটা পেরিয়ে প্রাসাদের সেই উন্মুক্ত চত্বরে এসে দাঁড়ালেন আর্মস্ট্রং।
কিন্তু নিমেষেই তার একটু আগের সেই খুশির ভাবটা মিলিয়ে গেল। প্রাসাদের সামনে উদ্যান আরাম কেদারায় বসে থাকা। ঐ বৃদ্ধ লোকটির দিকে নজর পড়তেই সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি। কে, কে ঐ লোকটি? অচেনা জায়গায় চেনা মুখ? আশ্চর্য। তাহলে তো এবার ভাল করে নজর দিতে হয়। মাছ-কাটা বাছার মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লোকটিকে দেখতে গিয়ে আর্মস্ট্রং-এর মনে পড়লো হা, তাকে তিনি চেনেন, বেশ ভাল করেই, উনি হলেন মিঃ ওয়ারগ্রেভ, জাস্টিস ওয়ারগ্রেভ। মনে পড়লো আর্মস্ট্রং-এর একবার একটা মামলায় ফাঁসী দেওয়ার জন্য সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। যেই মামলার বিচারক ছিলেন ঐ বৃদ্ধ লোকটি। সব সময় যেন ঝিমুচ্ছেন, বাদী-বিবাদী পক্ষের উকিলের সওয়ালের সময় কেমন নির্লিপ্ত ভাবে তিনি তার আসনে বসে ঝিমোন তবে আইন নিয়ে একটা কথা বলো সঙ্গে সঙ্গে ওঁর সেই ঝিমুনি ভাবখানা দেখবে উধাও, বেপাত্তা, তখন সচল হয়ে চোখ-কান খুলে রেখে শুরু করে দেন বক্তৃতা, ওঃ সেই বক্তৃতার ভাষা কতো না তীব্র হুল ফোঁটানো, চোখা চোখা বুলি আইনের কচকচি, তার আইনের যুক্তির কাছে দুদে-উকিলেরা হার মেনে যায়, জুরীরা ভয়ে তাদের মতামত জানাতে সাহস পায় না, পাছে তাঁর রায়ের শেষ কথাটি হলো মৃত্যুদণ্ড ফসি। তাই সবাই ওঁর নামকরণ করেছিলো ফাঁসুড়ে বিচারক।