দোতালায় লম্বা বারান্দায় একেবারে শেষ প্রান্তে একটা বন্ধ ঘরের সামনে এসে থামলো মিসেস রগার্স। নিজের হাতে ঠেলে বন্ধ দরজা খুলে দিলে সে। ঘরে ঢুকে ভেরা তো দারুন মুগ্ধ, তেমনি মুগ্ধ হয়ে তার দৃষ্টি ঘোরা-ফেরা করতে থাকলো ঘরের চারপাশে। চমৎকার ঘরখানি। বড় বড় দুটো জানালা দক্ষিণের ফ্রেমে ছবি হয়ে আছে। দুরন্ত সমুদ্র। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো সেই মনোরম দৃশ্য।
ভেরা এদিক ওদিক তাকিয়ে তার মনের খবর টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে মিসেস রগার্স চিন্তা করবেন না, আপনার সব জিনিষপত্র এনে দিয়েছি।
অবাক বিস্ময়ে ঘরের মধ্যে ভাল করে তাকাতে গিয়ে ভেরা দেখলো সত্যিই কাবার্ডের সামনে তার সব মালপত্র জড়ো করে রাখা আছে। ঘর সংলগ্ন ছোট্ট একটা বাথরুম ধবধবে দুধ সাদা মেঝে পরিস্কার ঝকঝকে।
বাঃ না চাইতেই জল ধন্যবাদ তার কাজের প্রশংসা জানাতে এক গাল হেসে বললো সে, আমি খুব খুশি।
প্রয়োজন হলেই দেওয়ালের দিকে ভেরার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো মিসেস রগার্স, ঐ বোতামটা টিপবেন নিচে ঘণ্টা বাজবে সঙ্গে সঙ্গে আমি এখানে এসে হাজির হবো কেমন?
ঠিক আছে তুমি এখন যেতে পারো
দরজার দিকে পা বাড়ায় মেয়েটি কিন্তু ভেরার ডাকে আবার ফিরে দাঁড়ালো সে। তার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বললো ভেরা, আমি যে মিসেস ওয়েনের নতুন সেক্রেটারী হয়ে এখানে এসেছি, এ খবরটা নিশ্চয়ই তুমি শুনে থাকবে।
তাই বুঝি? তার দুচোখের ভুরু বুঝিবা একটু কুঁচকে উঠলো, ভেরার আপাদমস্তক নিরক্ষণ করলো সে, তারপর সে তার কথার জের টেনে বললো কই শুনিনি তো। সত্যি আপনার ব্যাপারে আমি এখনো কিছুই জানি না। কেবল একটা নামের তালিকা আমার হাতে এসেছে–কে কে আসছেন এখানে তাদের মধ্যে কজন পুরুষ আর মহিলাই বা কজন। কার জন্যে কোন ঘর বরাদ্দ করা হবে তার একটা ফিরিস্তি। ব্যস এই পর্যন্ত। এর বেশি আর কিছু লেখা নেই সেই তালিকায়।
আমার ব্যাপারে, মিসেস ওয়েন কি কিছুই বলেন নি তোমাকে।
দেখা হলে তো বলবেন। আমরা এখানে এসেছি গত পরশু। কিন্তু এর মধ্যে দেখার সৌভাগ্য এখনো হয়নি আমাদের।
সে কি। অবাক হয়ে নিজের মনে ভাবে ভেরা-বড় অদ্ভুত ব্যাপারতো? আচ্ছা। এই ওয়েন দম্পতির স্বাভাবিক প্রকৃতির তো। নাকি মাথার গোলমাল আছে।
যাইহোক নিজেকে সামলে নিয়ে ভেরা বলে ঠিক আছে, তবে কাজের লোক কজন আছে বলতে পারো।
দুজন আমি আর আমার স্বামী।
একি কথারে বাবা? আমাকে নিয়ে আমরা মোট আটজন অতিথি, অথচ কাজের লোক মাত্র দুজন। এরা স্বামী স্ত্রী দুজনে সামলাবে কি করে আমাদের?
ভেরার আশঙ্কার কথা টের পেয়ে মেয়েটি মৃদু হেসে বললো, চিন্তার কিছু নেই। আমি বেশ ভালই রাঁধতে পারি। আর ঘরদোরের কাজ ওদিকটা আমার স্বামীটি তার যোগ্যতা দিয়ে অবশ্যই সামলে নিতে পারবেন। তবে আপনারা সবাই যে আসবেন ভাবতে পারিনি। অবশ্য এর জন্য আটকাবে না। দরকার হলে মিসেস ওয়েনকে বলে আমার দু একজন কাজের লোকের ব্যবস্থা করে নেবেন। ওঃ কথায় কথায় অনেক দেরী হয়ে গেলো, এখন আমি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে।
এবার সে চলে যাওয়ার জন্য অলস ভঙ্গিতে শিকারী বেড়ালের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। পলক-পতনহীন চোখে অপস্থয়মান মিসেস রগার্সের দিকে তাকিয়ে রইলো ভেরা। তারপর জানালার ধারে একটা আরামকেদারায় সে তার গা ভাসিয়ে দিলো।
এখন মনটা তার বড় অস্থির। হওয়ারই কথা, একটার পর একটা যা সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তাতে মন সুস্থিরই বা থাকবে কি করে। আহ্বায়ক ওয়েন দম্পতিদের অনুপস্থিতি, মিসেস রগার্সের নির্লিপ্তভাবে এসব দেখে শুনে মন চঞ্চল তো হবেই। তার ওপর আরো বেশি অবাক করে তুলছে অতিথিরা। একজনের সঙ্গে আর একজনের মিল নেই প্রত্যেকের মধ্যে কেমন যেন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। অথচ এই ভিন্ন ভিন্ন সমাজের লোকগুলোকে একই জায়গায় সমাবেশিত করা হয়েছে। কি তার উদ্দেশ্য তাও কেউ জানে না।
এমন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে, আগে জানলে ওয়েনদের সঙ্গে দেখা করে আসাটাই ভালো ছিল বোধহয়।
আরাম কেদারায় বসে আরাম করতে আর মন চাইলো না ভেরার। উঠে দাঁড়ালো সে।
চমৎকার বড় মাপের এবং সুসজ্জিত। মেঝেয় দামী কার্পেট, একপাশে ফায়ারপ্লেস, দেওয়ালে প্রমান সাইজের আয়না, আরো কিছু সুন্দর সুন্দর আকর্ষণীয় জিনিষপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘরের দেওয়ালের সেলফে। হঠাৎ দেওয়ালের একটা জায়গায় মেহগনি কাঠের একটা ফ্রেম ঝুলে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো সেদিকে সে। কৌতূহল হলো তার ঐ ফ্রেমের কি বাঁধানো আছে দেখার জন্য, কাছে গিয়ে ভাল করে দেখতে গিয়ে তার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ হলো তুলোট কাপড়ের ওপর কালো কালিতে লেখা কবিতার প্রতি। কি এমন কবিতা যে অমন যত্ন করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে? তার কৌতূহল বেড়ে গেলো আরো। বিত্তবানদের অন্য সব উদ্ভট উদ্ভট খেয়ালগুলোর মতো মনে হয় এটাও হয়তো তেমন একটা খেয়াল হবে। অফুরন্ত অবসর হাতে কাজে না থাকলে যা হয় আর কি-বসে বসে কবিতা লেখা, মনের উচ্ছ্বাস করার এটাই সহজ অধ্যায়।
যত্তো সব পাগলের প্রলাপ–
মনে মনে বিরক্ত হলেও কবিতাটি পড়ার কৌতূহল দমন করতে পারলো না ভেরা। আবৃত্তি করার ঢঙে পড়তে শুরু করলো সে—