ওয়েনের কথায় ভরসা নেই, ওসব বাজে কথা। আসলে সেই দ্বীপটির মালিক ঐ ওয়েন নয়, শোনা যায় দ্বীপটির মালিক হলেন সেই সিনেমার নায়িকা। মিস্ গ্যাব্রিয়েল টার্ল। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? সিনেমা জগতের অমন স্বনামধন্যা লাস্যময়ী নায়িকার অতিথি এই সব অতি সাধারণ মানুষগুলো হয় কি করে। তাই বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না।
লঞ্চযাত্রীদের মুখের উপর দিয়ে চকিতে একবার দৃষ্টি ফেলে পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নারাকট বিশ্লেষণ করে মিলিটারী গুফে। ঐ বুড়োটা ঐ অল্পবয়সী যুবকটি ঐ খিটখিটে স্বভাবের মেজাজী বুড়িটা। না এদের কারোর চেহারার সঙ্গেই হলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীদের কোন সাদৃশ্য নেই। ঐ যে ফুর্তিবাজ লোকটা কথা নেই, বার্তা নেই, কেবল বিকট শব্দ করে হাসে, আগে নিশ্চয় ব্যবসা-ট্যাবসা করতো সে। আর ঐ যে রোগাটে চেহারার লোকটা না ওঁকে একটু সম্মান দিয়ে দিয়ে ভদ্রলোকই বলবো, যিনি ছোট ছোট চোখ করে, তাকান দলের মধ্যে উনিই যা একটু ব্যতিক্রম। একমাত্র উনিই চিত্রজগতের কেউ একজন হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
ও হ্যাঁ, আর একজনের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম–আরে ঐ যে, একেবারে শেষ মুহূর্তে পরীক্ষরাজ ঘোড়ার মতো রাস্তায়, ধুলো উড়িয়ে তার গাড়ি চালিয়ে জোরে জোরে হর্ণ বাজিয়ে জেটির সামনে এলেন, যিনি সবাইকে দীর্ঘ সময় ধরে বসিয়ে রেখে স্রেফ তার ভাল চেহারার গুণে উপস্থিত সবাইকে দর্শন দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বশ করে নিলেন, তার ওপর সবার রাগ অভিমান নিমেষে জল করে দিলেন, আহা, একখানা চেহারা বটে। সত্যি যেন এক রাজপুত্তুর এলেন, জয় করলেন এবং চললেন তার অনুরাগীদের সঙ্গে নিয়ে। উনি নিশ্চয়ই কোটিপতি হবেন। তা না হলে অমন একখানা দামী গাড়ি স্টিকহ্যাভেনের বাসিন্দারা যে সে গাড়ি জীবনে কখনো চোখে দেখেনি, যার দাম লাখখানেকের কম নয়, কোটিপতি না হলে কেউ এমন দামী গাড়ি ব্যবহার করতে পারে? হাওয়ার গতির সঙ্গে সমানে পল্লা দিয়ে তিনি ছুটে আসছিলেন তার গাড়ি চালিয়ে আহা কি অদ্ভুতই না লাগছিল ওকে।
তবে যে যাই বলুক, একজনকে দিয়ে গোটা একটা দলের মাপকাঠি নির্ণয় করা যায় না। আসলে আমার কি মনে হয় জানেন, সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন একটু গোলমেলে খটমট লাগছে, একটু যেন অস্বাভাবিকই লাগছে আমার….
এক চক্কর পাহাড়টা প্রদক্ষিণ করে জল কেটে এগিয়ে চলছে লঞ্চটা। অনেকক্ষণ পরে দূর দ্বীপের মধ্যে সেই প্রাসাদটা চোখে পড়লো। সমুদ্র-মুখো প্রাসাদটা আধুনিক ডিজাইনে তৈরী। খোলামেলা প্রচুর আলো-বাতাস। এক কথায় অতি উত্তম।
দ্বীপের কিনারার কাছাকাছি পৌঁছে লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ করলো ফ্রেড। পাহাড় এবং তীরের মাঝখানের একটা খাঁড়িতে লঞ্চ ঢোকালো সে।
তীর ঘেঁষে পাথরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চটা একটা ঘুরপাক খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল একসময়। লঞ্চ থেকে নেমে এক হাঁটু জলে দড়ি ধরে টানতে টানতে লঞ্চটাকে তীরে ভেড়ালো নারাকট। এক এক করে সবাই নেমে গেলো লঞ্চ থেকে। শেষ লোকটি নামমাত্র মুহূর্ত দেরী না করে লঞ্চে উঠে পড়ে ইঞ্জিন চালু করে দিলো সে আবার। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার গতিতে ফিরে চললল লঞ্চ।
সিঁড়ির ধাপগুলো টপকে উপরে উঠতেই একটা বিরাট চত্ত্বর। প্রাসাদের চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন ম্যাকআর্থার বাঃ বেশ চমৎকার জায়গা বটে। মুখে বললেও নিজেরই তার কেমন অদ্ভুত লাগলো জায়গাটা, এবং নিজের মনেই বললেন তিনি জায়গাটা সত্যি অদ্ভুতই বটে এবং সেই সঙ্গে অতি কুৎসিত বলা যেতে পারে।
সেখানে তাদের আগমন দেখে প্রাসাদের প্রবেশ পথের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক খানসামা, মানানসই পোষাকে তার চেহারার মধ্যে বেশ একটা গাম্ভীর্য ভাব ফুটে উঠেছিল। তাকে দেখে বুকে বল এলো। এমন একটা বিঘ্রী জায়গায় এমন আকর্ষণীয় সাজের খানসামা।
দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে এসে মাথা নিচু করে জনে জনে সবাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানালো সে। লম্বা ছিপছিপে একটু রোগাটে গড়ন, তা হোক, চেহারার মধ্যে বেশ সম্রান্তের ভাব ফুটে উঠেছে কাঁচাপাকা চুল মাথা ভর্তি। এমন এক বিরাট প্রাসাদে তাকে ছাড়া আর কাকেই বা মানাতো ভালো।
বাইরে কেন, আসুন, আপনারা সবাই ভেতরে চলুন, হাসতে হাসতে পথ দেখালো সে। তার আহ্বানে সবাই সাড়া দিয়ে তাকে অনুসরণ করে একটা বিরাট হলঘরে এসে প্রবেশ করলো। চারিদিকে খোলা আলোয় ভরা হলঘরটা বিরাট, মাঝখানে টেবিল। পানীয়র বোতল থরে থরে সাজানো টেবিলটার ওপর যেন হালে পানি পেলো মাস্টার্ন। হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। বুড়োগুলোর রকম সকম যা, তার সঙ্গে কারোরই মিল নেই, না কারোর সঙ্গে নয়, বাডগার আর লোক পেলো না, এদের মধ্যে আমাকে ভিড়িয়ে দিলো।
মদের যা ঢালাও ব্যবস্থাও সব বুড়ো টুড়ো মানবো না, আমি আকণ্ঠ পান করবো, অন্তত যতক্ষণ হুঁশ থাকে, শুধু মদ আর মদ প্রাতরাশ থেকে শুরু করে মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশভোজে হবে চূড়ান্ত, এখানে বইয়ে দেবো মদের ফোয়ারা।
কিন্তু এদিকে আমরা যার অতিথি হয়ে এসেছি এই প্রাসাদে, তার তো পাত্তাই নেই। খানসামাটি জানিয়েছে মিঃ ওয়েনের আসতে নাকি দেরি হবে। সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে সে। দুঃখ? আর এর মধ্যে আবার দুঃখই বা কিসের বরং মিঃ ওয়েনের সামনে লজ্জায় হয়তো খুশি মতো মদের পিপে খালি করতে পারবো না। বরং এদিক দিয়ে আমার বাড়তি লাভই হবে বাপু। খানসামাকে জানিয়ে দিয়েছে আটটায় নৈশভোজের সঙ্গে মদেরও যেন ঢালাও ব্যবস্থা থাকে।…