ভোরের দুচোখে গভীর বিস্ময়, আপন মনে বিড়বিড় করে বললো সে, ওঃ। এ তো দেখছি অনেক দুর।
কিন্তু তার অনুমান বাস্তবের সঙ্গে খাপ খেলো না। একটু আগেই তার কল্পনায় ভাসছিল, তীরের কাছাকাছি সুন্দর একটি দ্বীপ, সেই দ্বীপের মাঝখানে একটি বিরাট শ্বেতপাথরের প্রাসাদ। কিন্তু কোথায়, কোথায় সেই প্রাসাদ? আর কোথায়ই বা দ্বীপ। কেবল চোখে পড়ে বিরাট এক পাহাড়ের চূড়া, কোনো এক বিরাট দৈত্যের ততোধিক বিরাট একটা মাথা, দ্বীপটা কেমন যেন অদ্ভুত দেখতে, ভুতুড়ে ভুতুড়ে ভাব।
সমুদ্রের দিক থেকে চোখ ফেরাতেই তাদের তিনজনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল তার। ছোট একটি সরাইখানার সামনে একটি বেঞ্চের ওপর বসেছিলেন তারা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। বৃদ্ধ ওয়ারগ্রেভ তার পাশে বসেছিলেন মেরুদণ্ড সোজা করে মিস ব্লেন্ট। আর মিস ব্লেন্টের পাশের দীর্ঘকায় লোকটি নাক উঁচু, হ্যাঁ উনি নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন।
এখানে একটু বসে ভালই করেছি, কি বলেন? মৃদু হেসে বললেন তিনি, সঙ্গী হিসাবে আপনাদের পেয়ে গেলাম, ভালই হলো, এক সাথে যাওয়া যাবে। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, এবার পরিচয়টা সেরে নেওয়া যাক। আমার নাম ডেভিস, দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে আমার কর্মক্ষেত্র–দেরী করে লাভ নেই। আমাদের অপেক্ষায় কৰ্ত্তারা বসে আছেন।
সবাই এতক্ষণ চুপচাপ অনড় হয়ে বসেছিলেন। কর্তাদের কথা উঠতেই সবাই নড়ে চড়ে উঠলো। ডেভিস তখন ইশারায় ডাকলেন একটি লোককে, সরাইখানার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। অনুমতি পেয়ে এগিয়ে এলো সে। তার চলার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেলা, সে নাবিক। কাছে আসতেই আরো স্পষ্ট হলো ওর চেহারাটা। রোদে জলে পোড়া রুক্ষ চেহারা কোটরগত দুই চোখে ধারালো দৃষ্টি। কাছে এসে বিনীত গলায় জিজ্ঞেস করলো সে, তা কত্তারা, এখনই রওনা হবেন নাকি? তাহলে আমার ঐ লঞ্চে উঠে বসুন, আরো দুজন গাড়িতে আসার কথা আছে। তবে মিঃ ওয়েনের হুকুম আছে, তাদের আসতে দেরী দেখলে আগেই আপনাদের পৌঁছে দিতে। তারা তো এখনো এলেন না। চলুন, আপনাদের আগে পৌঁছে দিয়ে আসি।
একটা ছোট্ট পাথরের জেটি, সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল সেই পাথরের জেটির ওপরে। জেটির পাশেই নোঙ্গর করা ছিল একটি লঞ্চ।
লঞ্চ দেখে ভুরু কোঁচকালেন এমিলি ব্লেন্ট ওমঃ এই ছোট লঞ্চ? এতগুলো লোক ধরবে কি করে ওতে?
দেখতে ছোট হলে হবে কি? লঞ্চের মালিক হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলো মিস ব্লেন্টের নাক সিটকানো ভাবটা। পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে আমার এই লঞ্চখানি। নিমেষে আপনাকে পলক ফেলতে না ফেলতেই প্রিমাউথ এক চক্কর ঘুরিয়ে আনতে পারে আমার এই ছোট্ট লঞ্চখানি।
তাদের কথার মধ্যে বাধা দিয়ে হঠাৎ ওয়ারগ্রেভ বলে উঠলেন, আমাদের সদস্য সংখ্যা কিন্তু খুব কম নয়।
তাতে ভয় পায় না আমার প্রিয় এই লঞ্চখানি। আপনাদের দ্বিগুণ যাত্রী নিয়েই স্বচ্ছন্দে ঘুরে আসতে পারি। তা একটু পরখ করেই দেখুন বাবু সাহেবরা।
পরখ নয়, মেনে নিলাম বাবা তোমার লঞ্চ-এর বিশেষ কৃতিত্ব আছে। তাগাদা দিলো লম্বার্ড এমন সুন্দর পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ঠিক গিয়ে পৌঁছবো নিগার আইল্যাণ্ডে। তারপর সে তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললো, চলুন, আগে ওঠা তো যাক।
সবাই একটু নড়ে-চড়ে উঠলো, বুঝি বা একটু ব্যস্ততাও লক্ষ্য করা গেল তাদের মধ্যে। প্রথমেই উঠলেন মিস ব্লেন্ট। তাকে অনুসরণ করলো বাকি সবাই। লঞ্চে উঠে কেউ কারোর সঙ্গে বাক্যালাপ করলো না, সবার দৃষ্টি তখন সমুদ্রের দিকে, সমুদ্রের মাঝখানে সেই দ্বীপটির দিকে।
নোঙর তুলে প্রস্তুত হলো নাবিক। লঞ্চ চালু করতে যাবে, এমন সময় দেখা গেলো ধুলো উড়িয়ে একখানা গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে আসছে জেটির দিকে। কি চমৎকার গাড়ি, দূর থেকে দেখে মনে হলো যেন একটা পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে আসছে হাওয়ায়। আর গাড়ির চালকটি আরো কত না সুন্দর। সুপুরুষ, এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে, ধবধবে সাদা রঙ গায়ের চোখে রঙীন গগলস।
প্যা-প্যাক-প্যাক, ক্রমাগত হর্ণ বাজাচ্ছিল মার্স্টান নাবিকের কর্ণগোচর করার জন্যে। হর্ণের তীব্র শব্দটা পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।
কি বিচিত্র মানুষ। সকলের দৃষ্টি তখন থমকে দাঁড়িয়েছিল আগুয়ান এ্যান্টনি মার্স্টানের দিকে। ঠিক এই মুহূর্তে তাকে এ-জগতের মানুষ হিসাবে ভাবতে কারোরই মন চাইছিল না।
ইঞ্জিন আর চালু করা সম্ভব হল না। ইঞ্জিনের সামনের আসনে বসেছিলেন ফ্রেড নারাকট। আর ভাবনা এখন অন্যরকম। লোকগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের? তার ধারণা ছিলো বেশ মানানসই পোষাক পরিহিত দেখতে সুন্দর উজ্জ্বল এবং চঞ্চল স্বভাবের এক ঝাক মুখ দেখতে পাবে, কিন্তু না কোথায়, সেরকম হিসেবে কোথায় যেন একটা
একথা ঠিক যে, নিয়োগকর্তা মিঃ ওয়েনকে চোখে দেখার সৌভাগ্য এখানো হয়নি। আর তার স্ত্রীকেও নয়। মিঃ ওয়েনের হয়ে কাজ করার সব অনুরোধ আদেশ দেয় মরিস নামে লোকটি। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কোন দরদস্তুর নয়, মুখের কথা খসাতে যতক্ষণ, একেবারে কারেন্সি নোটের বাণ্ডিল এসে যাবে হাতে তার মারফত। তাঁর হয় তো অনেক কাজই করলাম আজ পর্যন্ত টাকাও এলো অনেক। কিন্তু আদৌ একটা দুঃখবোধ রয়ে গেল, যাঁর হয়ে খাটা তাকে চোখের দেখা দেখতে পেলাম না, তাই মন ভরলো না আজও। ওয়েনকে নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছিল কয়েকদিন। ওঁর ব্যাপার-স্যাপার সব সময়েই যেন কেমন, ধোঁয়াটে একটা অস্পষ্টতার আবরণ। তখন সে সব অদ্ভুত অদ্ভুত খবরে কোন পাত্তা দিইনি, ভেবেছি কতো উড়ো, কতো অদ্ভুত-অদ্ভুত খবর তো বেরোয় পত্রিকাগুলোতে, গুরুত্ব কেই বা দেয়। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, কাগজের খবরই ঠিক। ওঁর সব কিছুই কেমন যেন বিচিত্র ধরণের। ওঁর সব কিছুই গোলমেলে।