পাইলট রুমের আলো কমিয়ে চ্যানিশ কো-অর্ডিনেটস ঠিক করতে লাগল। কন্ট্রোল বোর্ডের লাল আলোয় তার মুখে নিষ্ঠুর ভাব ফুটে উঠেছে। প্রিচার পা ভাঁজ করে পাইলটের আসনে বসেছে, মুখে হতাশা।
ধীরে ধীরে চ্যানিশের কো-অর্ডিনেটস বিন্দুগুলো স্ক্রিনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের জনবহুল সৌরজগতগুলো ফুটে উঠেছে।
‘এটা,’ চ্যানিশ ব্যাখ্যা করল ট্রানটর থেকে দেখা শীতের রাতের আকাশ। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তোমার অনুসন্ধানে তুমি ট্র্যানটরকে অবহেলা করেছ। যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি ট্র্যানটরকে জিরো পয়েন্ট ধরে তার কাজ শুরু করবে। ট্র্যানটর ছিল গ্যালাকটিক এম্পায়ারের রাজধানী। এমনকি প্রযুক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। সে কারণেই দশটার মধ্যে নয়টা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিকড় থাকবে ট্রানটরে। তুমি তো জানই, সেলডন হেলিকন গ্রহের অধিবাসী হয়েও তিনি ও তার সঙ্গীরা কাজ করেছেন ট্রানটরে বসে।
‘তুমি আমাকে কী দেখাতে চাইছ?’ প্রিচারের ঠাণ্ডা গলায় অপরজনের উৎসাহে ভাটা পড়ল।
‘ম্যাপই সব ব্যাখ্যা করবে। একটা কালো নেবুলা দেখতে পারছ? এর বাহুর এক অংশের ছায়া স্ক্রিনে পড়েছে, যার ফলে গ্যালাক্সির ঐ অংশটুকু অনুজ্জ্বল হয়ে আছে।‘ আঙুল দিয়ে সে ছোট একটি অংশ দেখিয়ে দিল, মনে হয় আলোর বুনটের মাঝখানে কালো গহ্বর। ‘স্টেলারগ্রাফিকেল রেকর্ডে এর নাম পিলটস নেবুলা। খেয়াল কর আমি ইমেজ বড় করছি।’
লেন্স ইমেজের কাজ প্রিচার আগেও দেখেছে। কিন্তু এখনও সে বিস্মিত হয়। অনেকটা হাইপারস্পেস ড্রাইভ ছাড়া কোটি কোটি নক্ষত্রের ভিড়ের মাঝে প্রচণ্ড গতিতে গ্যালাক্সি পাড়ি দেওয়ার সময় ভিজিপ্লেটে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। বুঝিয়ে বলা একটু কঠিন। মনে হয় স্ক্রিনের একটা নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে নক্ষত্রগুলো তাদের দিকে ছুটে আসছে, বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে স্ক্রিনের কিনারা দিয়ে। ছোট বিন্দু একটা থেকে দুটো হচ্ছে। তারপরই হয়ে যাচ্ছে বিশাল ভূ-গোলক। ঝাপসা কুয়াশা হঠাৎ করেই হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট অসংখ্য বিন্দু।
এর মাঝখানেই কথা বলছে চ্যানিশ, আমরা ট্র্যানটর থেকে পিলটস নেবুলার দিকে সোজা পথ ধরে এগুচ্ছি। আর তাই বাইরে যা দেখছি তার সাথে ট্রানটরের মহাজাগতিক অবস্থার মিল রয়েছে। লাইট গ্র্যাভিটেশনের কারণে কিছু ভুল হয়ে থাকতে পারে তবে সেটা খুবই সামান্য।
ম্যাগনিফিকেশনের গতি কমে যাওয়ায় স্ক্রিনে অন্ধকার বাড়ছে। কিনারা দিয়ে নক্ষত্রগুলো যেন অনেকটা অনিচ্ছার সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রসারমান নেবুলার শেষ প্রান্তে অসংখ্য নক্ষত্রের মহাবিশ্ব কেমন অদ্ভুত রকম উজ্জল, কারণ সামনের কিউবিক পারসেক অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সোডিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের অসংখ্য পরমানু, যেগুলো তাপ বিকীরণ করে না।
চ্যানিশ একটি অংশ চিহ্নিত করে বলল, মহাকাশের এই অংশের অধিবাসীরা একে বলে “মুখ।” গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে শুধু ট্রানটর থেকেই এটাকে মুখের মতো মনে হয়। সে যা নির্দেশ করছে সেটি নেবুলার গায়ের একটি ফাটল, দেখতে আসলেই অনেকটা অসমতল হাসি মুখের মত, নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলোয় পরিষ্কার ফুটে আছে।’
“মুখটাকে” অনুসরণ কর,’ বলল চ্যানিশ, ‘মুখ” থেকে খাদ্যনালীর মতো সরু পথ ধরে নিচের পাতলা একসারি আলোর দিকে যাও।’
পুরো স্ক্রিন জুড়ে এখন শুধু “মুখ” রয়েছে। চ্যানিশ সরু লাইন ধরে তার আঙুল একটি বিন্দুর উপর থামাল, সেখানে শুধু একটি নক্ষত্র একা জ্বলজ্বল করছে। এবং এর পরে রয়েছে সীমাহীন অন্ধকার, যা নক্ষত্রের আলোতেও দূর হয়নি।
“স্টারস এণ্ড” তরুণ সহজ গলায় বলল। ‘নেবুলার গঠন এখানে হালকা হয়ে গেছে এবং ঐ নক্ষত্র শুধু একদিকেই আলো বিকিরণ করছে, ট্রানটরের দিকে।‘
‘তুমি বলতে চাচ্ছ–’ মিউল জেনারেলের কণ্ঠে সন্দেহ।
‘আমি কিছু বলছি না। জেনডা–স্টারস এণ্ড।’
লেন্স বন্ধ হয়ে গেল। প্রিচার তিন লাফে চ্যানিশের কাছে পৌঁছল। ‘কীভাবে জানলে?’
চ্যানিশ চেয়ারে হেলান দিল। তার মুখে দ্বিধার ভাব। ব্যাপারটা আকস্মিক। আমারও কিছুটা কৃতিত্ব রয়েছে, তারপরও ব্যাপারটা পুরোপুরি আকস্মিক। এর সাথে অনেক যুক্তি মিলে যায়। আমাদের রেফারেন্স অনুযায়ী জেনডা শাসন করে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী। তারা সাতাশটি বাসযোগ্য গ্রহ শাসন করে। জেনডা প্রযুক্তির দিক দিয়ে উন্নত নয়। সবচেয়ে বড় কথা এটা একটি রহস্যময় পৃথিবী, মহাকাশের এই অংশের স্থানীয় রাজনীতিতে শক্ত নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে এবং তাদের সীমানা বৃদ্ধির কোনো আগ্রহ নেই। আমার মনে হয় গ্রহটা আমাদের দেখা দরকার।
‘মিউলকে তুমি ব্যাপারটা জানিয়েছ?’
‘না, জানাবও না। আমরা এখন মহাকাশে রয়েছি এবং প্রথম “হপ” এর প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
আকস্মিক আতঙ্কে লাফিয়ে উঠে ভিজিপ্লেট এডজাস্ট করে প্রিচার ঠাণ্ডা কালো মহাশূন্য দেখতে পেল। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দৃশ্যটার দিকে। তারপর ঘুরল। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হাত ব্লাস্টারের শক্ত মসৃণ বাটের উপর চলে গেছে।
‘কার আদেশে?’
‘আমার আদেশে, জেনারেল’-–প্রথমবারের মতো চ্যানিশ তাকে এইভাবে সম্বোধন করল–’তোমাকে আমি লেন্সের সামনে ব্যস্ত রেখেছিলাম। তাই তুমি কোনো গতি টের পাওনি, সন্দেহ নেই টের পেলেও ভেবেছিলে তা লেন্সে দেখা নক্ষত্রগুলোর গতি।‘