এর ফলে আরাম-আয়েস লাভ করা যায় ঠিকই তবে জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন আসে না। যেখানে অন্যান্য নদী অববাহিকার লোকেদের নিত্যই নূতন নূতন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হতো, যেখানে শর্করা নিত্যনূতন পদ্ধতি নিয়ে আসত, অথবা অধিবাসীদের নিজেকেও প্রতিরক্ষার নূতন কৌশল খুঁজে বের করতে হতো, সেখানে নীল অববাহিকার লোকদের এসব কিছুই করতে হতো না। পুরুষানুক্রমে পুরনো জীবনধারাই তারা যথেষ্ট মনে করত।
ইতিমধ্যে বহিরাগতরা নীল উপত্যকায় প্রবেশ করে এবং জোর করে স্থানীয়দের উপর তাদের শাসন কয়েম করে। স্থানীয়রা তাদের পূরনো রীতিনীতিকে এমন কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরেছিল যে ইতিহাসে তারাই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে রক্ষণশীল জাতি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছিল (চীনারা ব্যতিক্রম হলেও হতে পারে)।
তাদের লিখনপদ্ধতি জটিলই রয়ে গিয়েছিল, উদাহরণস্বরূপ, অসংখ্য প্রতীক, যার অনেকগুলিই নির্দিষ্ট শব্দ বোঝাত, আবার কতকগুলি শব্দাংশ। প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলের কোনো এলাকায় প্রতীকগুলিকে মাত্র ডজনদুয়েকের মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছিল, যার প্রত্যেকটি কোনো ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতীক ছিল। সেই কটি বর্ণের সাহায্যে হাজার হাজার শব্দ লেখা সম্ভব ছিল, যাতে করে পুরো লিখনপদ্ধতি সহজবোধ্য হয়েছিল।
নীল অববাহিকার অধিবাসীরা যেহেতু তাদের সভ্যতার প্রাচীনত্ব নিয়ে অহংকার করত, আর সেই প্রাচীন জীবনধারার মধ্যে নিজেদের শক্ত করে বেঁধে রাখার চেষ্টা করত, তাই পরবর্তী দুই সহস্রাব্দ পর্যন্ত তারা সেই বর্ণমালা গ্রহণ করেনি। একগুয়েমীভাবে তারা সেই দুর্বোধ্য কষ্টকর পদ্ধতিই আঁকড়ে ধরেছিল। প্রথম দিকে অভিনব ও কার্যকর হলেও এটা পরবর্তীকালে দুর্বহ বোঝয় পরিগণিত হয়। এরূপ রক্ষণশীলতা শুধু অন্য প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীর কাজে লেগেছিল যারা এগুলি ব্যবহার করে নীল অধিবাসীদের পেছনে ফেলে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল (বমানে চীনারা তাদের প্রতীকী লিখনপদ্ধতি পরিত্যাগ করেনি, মিশরীয়দের মতোই জটিল)।
আর একটা রক্ষণশীলতা লক্ষ করা যায় ক্যালেন্ডার সংক্রান্ত ব্যাপারে। নীল অববাহিকার পুরোহিতরা ৩৬৫ দিনের বৎসর উদ্ভাবন করেছিল। প্রতি চতুর্থ বৎসর হবে ৩৬৬ দিনের। এটা নির্ধারণ করা হয়েছিল নীলের বন্যার সাথে সম্পর্ক রেখে। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে নীলের বন্যা একটা নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করত। তবে ক্যালেন্ডারের এসব সংশোধনী সাধারণ লোকদের গ্রহণ করানো সম্ভব হয় নাই। লোকেরা অতীতের সব রীতি প্রথাকে আঁকড়ে ধরে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত, যদিও এতে করে আগামি বন্যার সময় নির্ধারণে জটিলতা দেখা দিত।
.
দুই মিশর
নীল অববাহিকার অধিবাসীরা তাদের দেশের নাম দিয়েছিল “খেম”। তাদের স্থানীয় ভাষায় এর আপাত অর্থ “কালো”। সম্ভবত নীলের বন্যায় রেখে যাওয়া কালো মাটি বোঝাতেই এই নামটা দেওয়া হয়েছিল। নীলের উভয় পার্শ্বে মরুভূমির লালচে বেলে মাটির সাথে যার পার্থক্য ছিল বেশ স্পষ্ট।
পরবর্তীকালে গ্রিকরা দেশটির নাম দিয়েছিল এইজিপ্টস। হয়তো তারা এই নামটা বিকৃতভাবে আহরণ করেছিল পরবর্তী এক বিখ্যাত মিশরীয় শহরের নামানুসারে যার সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা এই নামেই দেশটার সাথে পরিচিত।
সভ্যতার আদিপর্বে মিশর দেশটি ছিল অনেকগুলি ছোট ছোট শহর বা নোমস (nomes) নিয়ে যার প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা দেবতা, আলাদা মন্দির, পুরোহিত এবং প্রশাসক ছিল, যারা নদী এলাকার কৃষিভূমি নিয়ন্ত্রণ করত। এক শহর থেকে আর এক শহরের পরিবহণ বলতে ছিল একমাত্র জলপথ, আর তা ছিল বেশ সহজসাধ্য, কারণ জলপ্রবাহ ছিল এক দিকে আর বায়ুপ্রবাহ ছিল তার বিপরীত দিকে। পাল ছাড়া চলত একদিকে আর পাল তুলে তার বিপরীত দিকে।
প্রতিটি শহরের লোক একে অন্যের সাথে সহযোগিতা করত, ব্যাপারটাকে আরও সহজ করে তুলেছিল, কারণ শহরগুলিও একে অন্যের সাথে সহযোগিতা করত। তাদের মধ্যে মৈত্রী (League) স্থাপন করেছিল যার মাধ্যমে তারা প্রতিবেশী শহরগুলির মাধ্যমে সাধারণ সমস্যা দূর করার চেষ্টা করত। ঘটনাক্রমে কোনো কোনো শাসক নদীর বিশেষ এলাকায় দখল পোক্ত করার প্রয়াস পেত।
সাধারণভাবে অববাহিকাটি দুটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত ছিল একদিকে ছিল নদীর সরু উপত্যকা, যার বিস্তার ছিল প্রথম জলপ্রপাত থেকে লেক মিয়েরিস পর্যন্ত সমুদ্র থেকে মোটামুটি একশ মাইল। এটা ছিল এক সংকীর্ণ ভূভাগ যাকে বলা যায় আপার ঈজিপ্ট। আপার ঈজিপ্টের উত্তরে নীল নদ বেশ কয়েকটি জলধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে যা ১২৫ মাইল প্রশস্ত এক ত্রিভুজাকৃতি ভূখণ্ড। অনেকগুলি ধারায় বিভক্ত হয়ে নীল নদ সাগরে প্রবেশ করেছে, আর এসব জলধারার মধ্যবর্তী প্রত্যেকটি ভূখণ্ড উর্বর কৃষিভূমি। এই উর্বর কৃষিভূমি দীর্ঘদিনব্যাপী দক্ষিণের পাহাড় থেকে নীলের বয়ে আনা পলিমাটি দ্বারা সৃষ্ট।
আধুনিক ভূগোলবিদরা ম্যাপের মধ্যে লোয়ার ঈজিটকে আপার ইজিপ্ট দেখিয়ে মিশরের ম্যাপ এঁকেছেন তা সত্যিই কিত। তবে নদীই ছিল এর প্রতিভূ। কেউ যদি নদীর স্রোতকে অবলম্বন করে মোহনার দিকে অগ্রসর হয়, আমরা বলি “ভাটির” দিকে যাওয়া হচ্ছে, আর তার উল্টো দিকে গেলে বলি “উজান” দিকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো।