কাজেই নীল উপত্যকার মানুষরাই সর্বপ্রথম ৩৬৫ দিন ভিত্তিক একটা পঞ্জিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রতিটি বছরের মধ্যে ছিল বারোটি মাস, কারণ প্রতিটি বছরের সামান্য কম সময়ের মধ্যে চন্দ্রের বারোটি সুস্পষ্ট আবর্ত লক্ষ করা যেত। আর নীল নদের বাসিন্দারা (অন্য অনেকের মতো) চন্দ্রভিত্তিক একটা ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে শিখেছিল। প্রতিটি মাসের দৈর্ঘ্য ৩০ দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল, আর বছরের শেষ প্রান্তে অতিরিক্ত পাঁচ দিন যোগ করা হতো।
প্রাচীনকালে আবিষ্কৃত সকল ক্যালেন্ডারের মধ্যে এটাই সবচাইতে সরল ও ব্যবহার উপযোগী ছিল। ঐতিহাসিকরা এর আরম্ভকাল নির্ণয় করতে পারেননি, তবে ২৮০০ খ্রিস্টপূর্ব গ্রহণযোগ্য অনুমান মনে হয়। পরবর্তী তিন হাজার বছর ধরে এর চাইতে ভালো কোনো উপায় বের করা সম্ভব হয়নি। আর পরবর্তিকালে যে ক্যালেন্ডার আবিষ্কার করা হয়েছিল সেটার ভিত্তিও ছিল সামান্য সংশোধনসাপেক্ষে মিশরীয় ক্যালেন্ডার। সত্যি বলতে কি আমাদের বর্তমান ক্যালেন্ডার মিশরীয় ক্যালেন্ডারেরই অনুসারী।
তারপরেও নীলের বন্যা, মানুষের অধিকৃতি মুছে ফেলত্ব। সেই সীমানা পুনর্নির্ধারণের একটা উপায় বের করা আবশ্যক ছিল। হিসাবনিকাশের একটা পদ্ধতি ধীরে ধীরে উদ্ভাবিত হয়েছিল যাকে বলা হয় জিওমেট্রি (ভূ মাপন)। গণিতের অন্যান্য শাখারও উন্নতি হয়েছিল।
ভূমির সীমানা ও উৎপাদিত ফসলের রেকর্ড সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন সংখ্যার প্রতীক উদ্ভাবন আবশ্যক ছিল যা বিভিন্ন জাতি, আলাদা ফসল ও ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ও বিবরণ নির্ণয় করারও সহায়ক ছিল।
তাইগ্রিস ইউফ্রেতিস এলাকার লোকজন ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই এক ধরনের চিত্রলিপি আবিষ্কার করতে পেরেছিল যা বস্তুর প্রতিবিম্বরূপে চিত্রিত হতো। প্রথম দিকে এসব প্রতীকী চিহ্ন ছিল বেশ সরল, তবে ধীরে ধীরে তা জটিল রূপ ধারণ করে আর শেষ পর্যন্ত মানুষের যে কোনো ভাবনাকে রূপ দিতে সক্ষম হয়।
নীল উপত্যকার মানুষেরা লিখনশৈলীর ধারণা লাভ করেছিল সম্ভবত ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকা থেকে, উভয় অঞ্চলে যাতায়াতকারী বণিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। নীল উপত্যকার অধিবাসীরা শীঘ্রই প্রাপ্ত লিখনশৈলীকে তাদের ব্যবহার উপযোগী পরিবর্তন করে নেয়। তারা নিজেদের মতো করে প্রতীক চিহ্ন আবিষ্কার করে যা ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকার চাইতে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অল্প পরেই নীল উপত্যকার লিখন পদ্ধতি পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে।
এই লিখনপদ্ধতি মূলত পুরোহিতদের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণ জনগণ এসব জটিল প্রতীক চিহ্ন রপ্ত করতে পারেনি যেমনটা এযুগের সাধারণ মানুষ উচ্চতর গণিত আয়ত্ত করতে পারেনা। আরও কয়েক শতাব্দী পরে যখন এখানে গ্রিক পর্যটক ও সৈন্যদের ঢল নেমেছিল, তারা এই প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারেনি, তবে যেহেতু তারা এগুলি উত্তীর্ণ দেখেছিল শুধু মন্দিরের গায়ে, তাই তারা ধরে নিয়েছিল এগুলির নিশ্চয়ই ধর্মীয় তাৎপর্য আছে, আর তাই এর নাম দিয়েছিল হিয়ারোগ্লিফিক্স (পবিত্র খোদাই)।
.
নিরাপত্তা
সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে নীল উপত্যকায় উচ্চতর সভ্যতা গড়ে ওঠে আর দুটি ক্ষেত্রে ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকার সাথে তার পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তাইগ্রিস ইউফ্রেতিস এলাকার পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর প্রান্ত ছিল অরণ্যবেষ্টিত বর্বর জাতি অধ্যুষিত। অবিরাম আক্রমণ ও লুটপাটের ভয়ে নদীতীরবর্তী এলাকার গ্রামবাসীরা নিজেদেরকে প্রাচীরবেষ্টিত করে রেখেছিল। তাদের যেমন সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছিল, তেমনি অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধকৌশলেরও উন্নতি ঘটাচ্ছিল।
এই উপায়ে ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকার জনগণ অধিকাংশ সময়েই বর্বরদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। উপজাতীয় প্রশান্তির সময়ে সশস্ত্র গ্রামবাসীরা তাদের অস্ত্র ও লোকবল দিয়ে কী করেছিল? অলস হয়ে বসে থাকতে দিলে যে শহর তাদের নিয়োগ দিয়েছে, সেখানেই অশান্তি সৃষ্টি করতে পারত। সেক্ষেত্রে শহরগুলি স্বভাবতই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারত।
এ ধরনের লড়াই একক শাসনাধীন (সাম্রাজ্য) এলাকার বিরাট অংশে হরহামেশাই ঘটেছে। অপরপক্ষে, এসব লড়াই কৃষি ও কৃষিকাজে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি যেমন নষ্ট করত, তেমনি ঐক্যও ক্ষঙ্খিস্ত করত, যে ঐক্যের উপর কৃষির সমৃদ্ধি নির্ভরশীল ছিল, যার কারণে সূচনা হয়েছিল এক অন্ধকার যুগের যেখানে লক্ষণীয় সভ্যতার অধোগতি আর সমৃদ্ধির অবক্ষয়। ফলে পার্শ্ববর্তী বর্বরদের পক্ষে সাময়িক দখলদারির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।
নীল এলাকার অধিবাসীরা এসবের হাত থেকে বহু শতাব্দীব্যাপী মুক্ত থাকতে পেরেছিল। তাদের শান্তিময় এলাকার পূর্ব ও পশ্চিমে ছিল মরুভূমি, শত্রুবাহিনী যা সহজে অতিক্রম করতে পারত না। উত্তরে ছিল ভূমধ্যসাগর, আর প্রথম দিকে সৈন্য ও রসদ পরিবহণের মতো যথেষ্ট বড় জাহাজ ছিলনা, যাতে করে তারা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসতে পারে। দক্ষিণে ছিল প্রথম জলপ্রপাত, যা নীলের পথে পাড়ি দিয়ে নেমে আসা সম্ভব ছিল না।
তাই দীর্ঘদিন যাবৎ নীলের অধিবাসীরা বিচ্ছিন্ন নিরাপত্তার মধ্যে বাস করেছিল। তাদের গ্রামগুলি রয়ে গিয়েছিল নিরস্ত্র অনাক্রান্ত। কোনো কোনো আম ছিল বিশাল আয়তনের যাতে নীল উপত্যকাকে বর্ণনা করা যায় এক দীর্ঘ শহরতলীর শৃঙ্খলরূপে।