তবে এটা মোটেই কৃত্রিম কোনো জলাশয় নয়, আর মিয়েরিস একটি মিশরীয় শব্দ, যার অর্থ হ্রদ। হেরোডোটাসের অনেক আগেই উত্তর আফ্রিকার এই অঞ্চল অনেক বেশি জলাভূমিতে আকীর্ণ ছিল আর এটা তারই অবশেষ। এই হ্রদের পানিতে জলহস্তিসহ আরও অনেক শিকার্য জলজন্তু ছিল যার কারণে ৪৫০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এর তীর ঘেঁষে অনেক নব্য প্রস্তরযুগীয় বসতি গড়ে ওঠে।
তবে এই ভূভাগের অবিরাম শুষ্কভবনের কারণে এর জলাধারও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। পানির উচ্চতা কমার সাথে সাথে জলজ প্রাণীর সংখ্যাও হ্রাস পেতে থাকে। যার ফলে উপকূলবর্তী গ্রামগুলিও ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় চলে যায়, আর অন্যদিকে নীল উপত্যকায় সভ্যতার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে, যেখানে জীবনযাপন সহজলভ্য, কারণ এখানকার পানির প্রবাহ সুদূর দক্ষিণের পর্বতমালা থেকে উৎসারিত।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ নাগাদ মিয়েরিস হ্রদকে একটা শোভনীয় আকারে রাখা সম্ভব হয়েছিল। একে নীল নদের সাথে সংযুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছিল আর নদী উপকূলবর্তী জনগণকে এজন্য অনেক পরিশ্রম করতে হতো। এটা করার সগ্রাম এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, আর এখন হ্রদটা প্রায় নিঃশেষিত। এর জায়গায় এখন যা রয়েছে তা হলো একটা শুকনো নিচু ভূখণ্ড যার মাঝ বরাবর রয়েছে ত্রিশ মাইল দীর্ঘ আর পাঁচ মাইল চওড়া ছোট একটা হ্রদ। এই জলাধারটি এখানকার আরবী ভাষাভাষী লোকের কাছে পরিচিত বিরকেত কারুন নামে। এটাই সেই প্রাচীন মিয়েরিস হ্রদের অবশেষ। এই ক্ষুদ্র জলাশয়ের তীরেই রয়েছে আধুনিক শহর এল ফাইয়ুম।
নীল নদের তীরে যে নিওলিথিক বসতি গড়ে উঠেছিল (যা ঘটেছিল মিয়েরিস তীরের বসতির পরবর্তী ঘটনা) পরবর্তীকালে তা-ও উৎখাত হয়ে যায়। পরবর্তী গ্রামগুলির অবশেষ দেখা যায় পূর্ববর্তী গ্রামের উপরিভাগে। পুরাতত্ত্ববিদরা প্রতিটি প্রাচীন গ্রামের নাম দিয়েছেন সেখানকার আধুনিক গ্রামের নামানুসারে যেখানে খনন করে উল্লেখযোগ্য অবশেষ পাওয়া গেছে।
তাই বলা হয়ে থাকে তাসিয়ান, বাদারিয়ান, আম্রাশিয়ান ইত্যাদি কালচার। তাসিয়ান জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যেই কৃষিকাজ শুরু করে দিয়েছিল। বাদারিয়ানরা উন্নত মানের মাটির পাত্র তৈরি করতে পারত। আম্ৰাশিয়ানরা গরু, ভেড়া, শূকর ইত্যাদি পশুপালন করত আর নলখাগড়া দিয়ে নৌকা বানিয়ে নীল নদে পাড়ি জমাত।
.
সেচ
পশ্চিম এশিয়ার আদি কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠী কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল শুধু সেসব এলাকায় যেখানে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির পানি সহজলভ্য ছিল। ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলকায়, বিশেষ করে নীল উপত্যকায়, কৃষিকাজে পানি সরবরাহের জন্য বৃষ্টির উপর একান্ত নির্ভরতা সম্ভব ছিল না। তার পরিবর্তে নদীর পানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।
প্রথম দিকে নীল অববাহিকার অধিবাসীদের বন্যার পানি অপসৃত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই যথেষ্ট ছিল, তারপর কর্দমাক্ত মাটিতে বীজ ছিটিয়ে দেওয়া। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই পদ্ধতিতে ফসল ফলানো যথেষ্ট ছিল না। তার পরিবর্তে নদীর উভয় পার্শে খাল কেটে দূরবর্তী এলাকায় পানি সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়েছিল। একটি ক্যানাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নীল এবং ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকায় সেচ দিয়ে শুষ্ক মওসুমে যখন বন্যার পানি সহজলভ্য ছিল না তখনও ভূমিতে আর্দ্রতা বজায় রাখা সম্ভব হতো।
এটা একদিক দিয়ে অবস্থা আরও কঠিন করে তুলেছিল। প্রথমত খাল কাটা কাজটা তেমন সহজ ছিল না আর সেটা ব্যবহার উপযোগী রাখাও ছিল তেমনি কঠিন। কঠোর পরিশ্রম করতে হতো, বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করার চাইতে অনেক বেশি কঠিন। কাজটা করতে হতো অনেকে একসাথে মিলেজুলে- সাধারণ কৃষিকাজের চাইতে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধভাবে।
প্রকৃতপক্ষে, এই অতিরিক্ত ঐক্যের প্রয়োজনে, এবং সেচ ব্যবস্থায় উন্নত কৌশল উদ্ভাবন উচ্চভূমিতে সাধারণ কৃষির চাইতে সেচ এলাকায় সমৃদ্ধ কৃষি, সভ্যতার অগ্রগতিতে বিশেষ উদ্দীপনা প্রদান করে।
নদী তীরবর্তী শহরগুলিকে সুসংগঠিত করতে হয়েছিল। যেসব কুশলী জনগণ ক্যানেল তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ পারদর্শী ছিল তারাই শহরগুলিতে প্রাধান্য লাভ করত। কোনো স্থানীয় দেবতার নামে তারা নিজেদের মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করত।
আদি যুগের মানুষেরা সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে যে কোনো না কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বীজ থেকে চারা উৎপাদন এবং বৃক্ষ ফলবান করা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, আর শহরের নিয়ন্ত্রককেই নির্দিষ্ট দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য উপযুক্ত যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করতে হয়। সাধারণ জনগণের দায়িত্ব পুরোহিতরা যেন সঠিকভাবে সকল আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখা। সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করত যাদের উপর এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের দায়িত্ব, তাদের জ্ঞান ও সচেতনতার উপরই শহরের সমৃদ্ধি নির্ভর করে। এভাবেই নীল উপত্যকায় একটি পুরোহিত-তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল যা হাজার হাজার বছর ধরে টিকেছিল।
সেচ কাজে যেটুকু কষ্টভোগ করতে হয়েছিল এর সুফলের তুলনায় সেটা অতি তুচ্ছ। মানুষ যত বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শিখেছিল তত বেশি সুবিধা ভোগ করতে পেরেছিল। উদাহরণস্বরূপ মানুষকে জানতে হয়েছিল ঠিক কখন নীল নদে বন্যা আসবে, যদি এর থেকে সর্বাধিক ফল লাভ করতে হয়। যেসব পুরোহিতের ওপর বন্যা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল তারা দিনের পর দিন নদীর পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করত, আর তাতে করে তারা নির্ণয় করতে পেরেছিল গড়ে প্রায় ৩৬৫ দিন পর পর বন্যা আসে।