মানুষ যখন প্রথম নীল উপত্যকায় প্রবেশ করে, তখন বন্যা ছিল প্রবল আর বিস্ত ত ছিল জলাভূমি আর নদীর উভয় তীরে ছিল অসংখ্য জলহস্তি, বল্গাহরিণ, সারস, আরও নানা রকমের শিকার্য পশু। ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা বন্যা কমিয়ে আনল আর শেষ পর্যন্ত শুধু নদীর দুই তীরেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল, আর বহু সহস্র বছর পূর্ব থেকে আজ পর্যন্ত বহমান নদীর দুই ধারে শুধু বার মাইল পর্যন্তই নীল নদের সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকারূপে টিকে রইল।
তারচেয়েও বড় কথা উর্বর চাষযোগ্য ভূমির সীমানা এমন স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায় যে কোনো ব্যক্তি এক পা উর্বর ভূমিতে আর অন্য পা মরুভূমিতে রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
.
নব্য প্রস্তর যুগ
সময়ের সাথে সাথে যেহেতু নীল উপত্যকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়তে থাকে আর সেই সাথে শিকার্য পশু কমতে থাকে, তাই কিছু একটা উপায় বের করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। যে কোনো ভাবেই হোক খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। সৌভাগ্যবশত ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন উত্তরের হিমবাহ তার শেষ ধাপে গিয়ে পৌঁছেছিল তখন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা নতুন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল। নীল নদের হাজার মাইল পূর্বে ইরান ও ইরাকে- যেখানকার উঁচু ভূমিতে পানির প্রাচুর্য। সেখানে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ বীজ থেকে ফসল উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছিল।
এটাকেই বলা যায় নিওলিথিক এজ বা নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা। নব্য প্রস্তর যুগের মানুষরা তখন পর্যন্ত ধাতুর ব্যবহার শেখেনি আর তাই পাথরের উপচারের উপরই নির্ভর করতে হতো। এসব পাথরের যন্ত্রপাতি আদি ও মধ্য প্রস্তর যুগের ভোতা অমসৃণ যন্ত্রপাতির চাইতে অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও কার্যকর ছিল। নব্য প্রস্তর যুগের আর সব অগ্রগতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মাটির পাত্র তৈরি, পশুপালন ও পশুচারণ, আর বলা উচিত, বীজ বপন ও ফসল কর্তন। আমরা সঠিকভাবে বলতে পারব না কীভাবে এই কৃষি যুগের উত্থান ঘটে, তবে এর ফল সহজবোধ্য, কারণ এর ফলে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছিল।
নব্য প্রস্তরযুগীয় জীবনধারা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় পৌঁছানোর আগে সেখানকার মানুষের জীবিকা নির্ভর করত পশু শিকার, ও ফলমূল সংগ্রহের উপর। তবে শিকার ও ফলমূলের সরবরাহ অঢেল ছিল না, আর কোনো কোনো দুর্বৎসরে খাদ্য সরবরাহের জন্য মানুষকে দূর দূরান্তে ভ্রমণ করতে হতো। কোনো সীমাবব্ধ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না।
পশুপালন ও ফসল ফলানো আয়ত্ত করার পর প্রাকৃতিকভাবে আহরণের চাইতে খাদ্য সরবরাহ মানুষের জন্য অনেক বেশি নিশ্চিত করা সম্ভব হলো। কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় পশুপালন ও ফসল ফলানো নিশ্চিত করার পর পশুপালক ও কৃষকদের ব্যবস্থা নিতে হলো যাতে বন্য পশু বা অন্য গোত্রের লোকজন সেগুলি নষ্ট না করে বা দখল করে না নেয়। খাদ্য সরবরাহ যেমন পরিমাণে বৃদ্ধি পেল তেমনি সুরক্ষিতও রইল, আর এটা কৃষির জন্য অধিকতর প্রযোজ্য হলো, কারণ পশুপালনের চাইতে ফসল ফলানো অধিকতর সহজ এবং নিরাপদ। এক একর কৃষি জমি এক একর বনভূমির চাইতে অনেক বেশি পরিমাণ মানুষের খাদ্য নিশ্চয়তা দিতে পারে। আর এ কারণেই যেখানেই নব্য প্রস্তর যুগের অনুপ্রবেশ সেখানেই এটা জনসংখ্যা বৃদ্ধিরও কারণ হয়ে দাঁড়াল।
অধিকন্তু, যেখানেই মানুষ শিকারের উপর নির্ভরশীল (অথবা কিয়ৎ পরিমাণে পশুপালন বা পশুচারণ) তারা কখনোই এক জায়গায় স্থিতিশীল ছিল না। অপরপক্ষে যারা যেখানে ফসল ফলাত, সেখানেই তাদের বসবাস করতে হতো। তাদের বাস করতে হতো একত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে, কারণ শিকারি বা পশুপালক গোষ্ঠীর হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল (এসব উটকো লোক নিজেরা ফসল না ফলালেও অন্যের ফসল ছিনিয়ে নিতে আপত্তি ছিল না)। আর এভাবেই গড়ে ওঠে আদিম বসতি গ্রাম ও নগর।
যেহেতু গ্রামের বাসিন্দাদের একে অন্যের সাথে বাধ্য হয়ে মানিয়ে চলতে হতো, তাই শিকারি যুগের স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটল। আর তাই ঘরবাড়ি নির্মাণ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ভূমি কর্ষণ প্রভৃতি কাজের জন্য গ্রামবাসীদের ঐক্য গড়ে উঠল। আর এভাবেই ঘটল সভ্যতার গোড়া পত্তন।
ইরানের উচ্চভূমিতে গোড়াপত্তনের পরবর্তী সহস্রাব্দে কৃষিকাজ চতুর্দিকে সম্প্রসারিত হতে থাকে। অন্যান্য গোষ্ঠীর লোকেরাও কৃষিকে আপন করে নেয় আর বিশেষ করে দুটি এলাকায় এর ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এর মধ্যে একটা দুই নদী ইউফ্রেতিস ও টাইগ্রিসের মধ্যভাগের উপত্যকায়, আর অন্যটি এর হাজার মাইল পশ্চিমে নীল নদের উপত্যকায়। ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকা নিকটবর্তী হওয়ায় ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল বেশ আগেই, আর সভ্যতার উন্নয়নও ঘটেছিল আগেভাগেই- তবে নীল উপত্যকাও তেমন পিছিয়ে ছিল না।
মিশরে নব্য প্রস্তরযুগীয় জীবনধারার পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ। এ সময় নীল উপত্যকা ছিল সুস্থির, তবে কর্দমাক্ত আর অরণ্যসংকুল থাকায় কৃষিকাজের জন্য তেমন উপযুক্ত ছিল না, কিন্তু নীলের পশ্চিম তীরে আর ভূমধ্যসাগরের প্রায় ৪৫০ মাইল দক্ষিণে ছিল একটা হ্রদ, যার আশেপাশের এলাকা ছিল কৃষিকাজের জন্য আদর্শ।
পরবর্তীকালে এই জলাধারটির পরিচিতি হয়েছিল মিয়েরিস হ্রদ নামে, কারণ প্রায় ৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক ঐতিহাসিক পর্যটক হেরোডোটাস এখানে বেড়াতে এসে হ্রদটা দেখে ভেবেছিলেন এক পৌরাণিক রাজা মিয়েরিস কর্তৃক কৃত্রিমভাবে বানানো হয়েছিল এটি।