প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে পেলোরেট যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে এবং এই প্রথমবারের মতো সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের ছুটি নিয়েছে–উদ্দেশ্য জীবনে প্রথমবার মহাকাশ পাড়ি দিয়ে ট্রানটরে যাবে।
পেলোরেট ভালো করেই জানে টার্মিনাসের কোনো বাসিন্দার স্পেস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকা অস্বাভাবিক। সে ইচ্ছে করে এই অস্বাভাবিকতা অর্জন করে নি। ব্যাপারটা এমন–যখনই কোথাও যাবার প্ল্যান করেছে তখনই তার হাতে নতুন কোনো বই নতুন ধরনের বিশ্লেষণ এসে হাজির হয়েছে। কাজেই ভ্রমণের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে নিজের পাহাড়-প্রমাণ জ্ঞান ভাণ্ডারে নতুন কিছু যোগ করাটাই মনে হয়েছে সঠিক। দুঃখ শুধু একটাই ট্রানটরে এখন পর্যন্ত সে যেতে পারে নি।
ট্রানটর ছিল প্রথম গ্যালাকটিক এম্পায়ারের রাজধানী। বারো হাজার বছর ধরে এই গ্রহ ছিল সম্রাটদের পদচারণায় মুখর, তারও আগে ছিল প্রি-ইম্পেরিয়াল যুগের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের রাজধানী, এই রাজ্যই ধীরে ধীরে অন্য রাজ্যগুলোকে গ্রাস করে গড়ে তোলে সুবিশাল সাম্রাজ্য।
ট্রানটর ছিল মহাবিশ্বের রক্ষক নগরী, মেটাল কোটেড সিটি। পেলোরেট এগুলো জেনেছে ডাল গরনিকের লেখা পড়ে। গরনিক হ্যারী সেলডনের যুগে ট্র্যানটর ভ্রমণ করেছিল। তার লেখা বই এখন এতই দুপ্রাপ্য হয়ে পড়েছে যে, পেলোরেটের কাছে যে বইটা আছে তার জন্য যে কোনো ইতিহাসবিদ তার সারাবছরের বেতন হাসিমুখে দিয়ে দিতে রাজী হবে।
অবশ্য যে জিনিসটা পেলোরেটকে বেশি আকর্ষণ করে তা হলো গ্যালাকটিক লাইব্রেরি, ইম্পেরিয়াল যুগে (তখন ছিল রাজকীয় গ্রন্থাগার) এটাই ছিল সবচেয়ে বৃহৎ এবং সমৃদ্ধ। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জনবহুল, রাজ্যের রাজধানী ছিল ট্র্যানটর এবং এর লাইব্রেরিতে মানবজাতির সৃষ্টিশীল, অসৃষ্টিশীল সমস্ত কর্মকাণ্ডের রেকর্ড রাখা আছে। রাখা আছে মানবসভ্যতার অর্জিত সমস্ত জ্ঞান। জটিল কম্পিউটারাইজড পদ্ধতির কারণে বিশেষজ্ঞ ছাড়া এখানে কারো পক্ষে কাজ করা অসম্ভব।
সবচেয়ে বড় কথা লাইব্রেরি আজো টিকে আছে। পেলোরেট-এর কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হয়। দুইশ পঞ্চাশ বছর আগে যখন ট্র্যানটর ধ্বংস হয়ে যায়, তখনকার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও লাইব্রেরিটা টিকে গেছে। ধারণা করা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুকৌশলে এটা রক্ষা করেছিল (কারো মতে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের ব্যাপারটা বাড়িয়ে বলা হয়েছে।)
যেভাবেই হোক, এমন ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও লাইব্রেরি টিকে গেছে। এবলিং মিস্ বিধ্বস্ত গ্রহের এই অক্ষত লাইব্রেরিতে বসেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে প্রায় ধরে ফেলেছিল (গল্পটা ফাউণ্ডেশনের সবাই বিশ্বাস করলেও ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।) ডেরিলদের তিন প্রজন্ম বেইটা, টোরান এবং আর্কেডি–প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় ট্রানটরে বাস করেছে। যদিও আর্কেডি কখনো লাইব্রেরিতে যায়নি এবং তারপরে গ্যালাকটিক ইতিহাসে এই লাইব্রেরির আর কোনো উল্লেখ নেই।
একশ বিশ বছরের মধ্যে ট্র্যানটরে কোনো ফাউণ্ডেশনারের পা পড়েনি। তার মানে এই না যে লাইব্রেরিটা সেখানে নেই, আবার আছে এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণও নেই। তবে ধ্বংস হলে কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি হতো।
গ্যালাকটিক লাইব্রেরি অপ্রচলিত এবং সুপ্রাচীন–ঠিক পেলোরেট যেমন চায়। প্রাচীন কোনো লাইব্রেরির কথা মনে হলেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যত বেশি পুরনো হবে ততই তার প্রয়োজনীয় উপাদান থাকার সম্ভাবনা বেশি হবে। প্রায়ই সে। কল্পনায় লাইব্রেরিতে ঢুকে প্রশ্ন করে, লাইব্রেরির কি পরিবর্তন হয়েছে? প্রাচীন রেকর্ডগুলো কি ফেলে দেয়া হয়েছে? এবং কল্পনায় বুড়ো লাইব্রেরিয়ানের জবাব শুনতে পারে সে, যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে, প্রফেসর।
তার স্বপ্ন সত্য হতে চলেছে। মেয়র নিজে আশ্বাস দিয়েছেন। তার ব্যাপারে মেয়র এত কিছু কিভাবে জানলেন সে বলতে পারবেনা। প্রকাশনার ক্ষেত্রে সে সফল হতে পারেনি। গবেষণা যতটুকু করেছে তার খুব সামান্যই ছাপার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, সেগুলোও উল্লেখযোগ্য কিছু না। তবে সবাই বলে যে, টার্মিনাসের সব কিছুই ব্র্যান্নো দ্যা ব্রোঞ্জের নখদর্পণে রয়েছে। পেলোরেট-এর বিশ্বাস করতে আপত্তি নেই, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মেয়র যদি জানতেনই, তাহলে টার্মিনাসের কসম, এর আগে কেন তিনি আর্থিক সাহায্য করেননি?
চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে সে শুধু একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে সেটা হচ্ছে ফাউণ্ডেশনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে দ্বিতীয় এম্পায়ার। অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করার কোনো সময় বা ইচ্ছা তাদের নেই।
সব বোকা, অবশ্যই, কিন্তু সে একা কারো ভুল ভাঙাতে পারবেনা। সেই চেষ্টা করাই ভালো। বরং তার আকাঙ্ক্ষা তার কাছেই থাক। অবশ্যই সেই সময় আসবে যখন সবাই তার অগ্রণী ভূমিকার কথা স্মরণ করবে।
এক অর্থে সে নিজেও ভবিষ্যৎকে নিয়ে ডুবে আছে–যে ভবিষ্যতে সবাই তাকে সেলডনের মতো মহানায়ক হিসাবে, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও মহান হিসাবে বিবেচনা করবে। কারণ, পঁচিশ সহস্রাব্দ পুরনো অতীত ইতিহাসের ভিত্তিতে সে এক সহস্রাব্দ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের পরিষ্কার ছবি বর্ণনা করে যাবে।
এবং সুদিন চলে এসেছে।
মেয়র তাকে বলেছিলেন দিনটা হবে সেলডনের প্রত্যাবর্তনের পরের দিন। এই কারণেই যে সেলডন ক্রাইসিস গত একমাস প্রতিটি টার্মিনাসবাসীর এবং অবশ্যই ফাউণ্ডেশনের সকলের মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেটার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল সে।