ইশ। কাল বড্ড দেরি হয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে ওকে আগামীকাল। ও আবার শুধাল, আচ্ছা, এখানে অবজারভেশান টাওয়ার বা ঐ জাতীয় কিছু নেই? মানে বলতে চাইছি খোলা জায়গায়?
অবশ্যই আছে! যদি চান সে-জন্যেও টিকিট কিনতে পারেন। দাঁড়ান, আগে চেক করে দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা। কনুইয়ের কাছে একটা কনট্যাক্ট ক্লোজ করল লোকটা। অস্বচ্ছ একটা ক্রীনে ফুটে ওঠা লেখাগুলো পড়ল। গালও পড়ে ফেলল তার সঙ্গে।
রুম ক্লার্ক বলল, চমৎকার আবহাওয়া। বোঝা যাচ্ছে, শুকনো মৌসুম এখন। আলাপ জমাবার সুরে যোগ করল, আমি নিজে অবশ্য বাইরের ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। শেষ খোলা আকাশের নিচে গেছি তা প্রায় তিন বছর হতে চলল। একবার দেখলেই, বুঝলেন, দেখার কিছু আর থাকে না তেমন। এই নিন আপনার টিকেট। স্পেশাল এলিভেটরটা একদম শেষের দিকে। টু দ্য টাওয়ার লেখা আছে দেখবেন। ওটাতে চড়লেই চলবে।
এলিভেটরটা নতুন ধরনের। গ্র্যাভিটিক রিপালশানের সাহায্যে চলে। ঢুকে পড়ল গাল। ওর পেছনে স্রোতের মত অন্যরাও ঢুকে গেল। একটা কনট্যাক্ট ক্লোজ করল অপারেটর। মুহূর্তের জন্য গালের কাছে মনে হল, অভিকর্ষ পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। এবং মহাশূন্যে ভাসছে সে। তারপরই এলিভেটরটা ওপরে উঠতে শুরু করায় ধীরে ধীরে ওজন ফিরে পেল সে। এরপর শুরু হল মন্দন আর সঙ্গে সঙ্গে ওর পা জোড়া মেঝে ছেড়ে উঠে গেল ওপরে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চেঁচিয়ে উঠল সে।
তীক্ষ্ণ গলায় অপারেটর বলে উঠল, রেলিং-এর নিচে পা ঢুকিয়ে দিন। সাইনটা পড়তে পারেন না?
অন্যরা আগেই সেরেছে কাজটা। ওকে পাগলের মত দেয়াল আঁকড়ে নিচে নামার ব্যর্থ চেষ্টা করতে দেখে হাসছে সবাই। তাদের জুতো মেঝে বরাবর দু ফুট দূরে দূরে সমান্তরালভাবে বসানো ক্রোমিয়ামের প্রলেপ দেয়া রেলিং-এর ওপরের দিকে সেঁটে আছে। ঢোকার সময়ই গাল লক্ষ্য করেছিল রেলিংগুলো; কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি।
হঠাৎ একটা হাত এগিয়ে এসে ট্রেনে নামিয়ে নিল ওকে।
হাঁফাতে হাঁফাতে ধন্যবাদ জানাল গাল ত্রাণকর্তাকে। ততোক্ষণে থেমে গেছে এলিভেটর।
খোলা একটা চাতালে পা রাখতেই রোদ্রের তীব্রতায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল গালের। যে-লোকটা একটু আগে ওকে সাহায্য করেছিল সে ওর ঠিক পেছনেই রয়েছে।
লোকটা নরম গলায় বলল, অনেক সীট আছে।
গাল মুখ বন্ধ করল, হাঁফাচ্ছে সে তখনো। বলল, তাইতো দেখছি, তারপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে এগিয়ে গেল সেদিকে। দু পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। বলল, যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটু রেলিং-এর কাছে দিয়ে দাঁড়াব কিছুক্ষণের জন্যে। আ-আমি একটু ভাল করে দেখতে চাই।
স্মিত হেসে হাত নেড়ে ওকে এগিয়ে যেতে বলল লোকটা। কাঁধ-সমান উঁচু রেলিং এর সামনে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল গাল। সামনের বিশাল দৃশ্যপটে ডুবিয়ে দিল নিজেকে।
মাটি পর্যন্ত চোখ পৌঁছল না ওর। মানুষের তৈরি বিভিন্ন ক্রমবর্ধমান কাঠামোর জটিলতায় হারিয়ে গেছে ভূ-পৃষ্ঠ। এমনকি দিগন্তও দেখতে পেল না গাল। বরং সেখানে আকাশের গায়ে সবখানে প্রায় একই রকম ধূসরতা নিয়ে বিস্তৃত হয়ে আছে ধাতব দিগন্ত। ও জানে, গ্রহটির সমস্ত ল্যাণ্ড-সারফেস জুড়েই এই অবস্থা। কোথাও তেমন কোনো নড়াচড়া নজরে পড়ল না ওর। আকাশের গায়ে কয়েকটা প্রমোদতরী ভেসে বেড়াচ্ছে শুধু। কিন্তু গাল জানে, কোটি কোটি লোকের ব্যস্ত চলাচল রয়েছে গ্রহটির ধাতব চামড়ার নিচে।
সবুজের কোনো চিহ্ন নেই; সবুজ নেই, মাটি নেই, মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণী নেই। অথচ, ও অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করল, এই গ্রহেরই কোথাও একশো বর্গমাইল জায়গা জুড়ে সম্রাটের যে প্রাসাদ রয়েছে সেখানে সবই আছে- মাটি, সবুজ গাছপালা, নানান ফুলের রঙধনু- সব। ইস্পাতের সমুদ্রের মধ্যে এটা একটা ছোট্ট দ্বীপ। কিন্তু ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছে না জায়গাটা। হয়ত সেটা দশ হাজার মাইল দূরে কোথাও। জানে না গাল।
খুব তাড়াতাড়ি ট্যুরে যেতে হবে ওকে!
শব্দ করে শ্বাস ফেলল গাল। ভাবল, অবশেষে সত্যি তাহলে ট্রানটরে এসেছে সে; গোটা গ্যালাক্সির কেন্দ্র আর মানব জাতির মর্মস্থলে সত্যি তাহলে পৌঁছুছে সে। গ্রহটার কোনো দুর্বলতা ধরা পড়ল না ওর চোখে। খাদ্য নিয়ে কোনো শিপকে ল্যাণ্ড করতে দেখেনি সে। ট্রানটরের চল্লিশ বিলিয়ন লোককে গ্যালাক্সির বাকি অংশের সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে যুক্ত করছে যে প্রাণ-প্রবাহ, সে সম্পর্কেও সচেতন নয় গাল। ওর চোখে শুধু ধরা পড়ছে মানুষের প্রবলতম কীর্তি; একটি গ্রহের সম্পূর্ণ এবং প্রায় উদ্ধত রকমের চূড়ান্ত বিজয়।
কেমন একটা ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে ফিরে এল সে। ওর এলিভেটরের বন্ধু তার পাশের সীটটা দেখিয়ে দিল। গাল বসে পড়ল সেখানে। হাসল লোকটা। আমার নাম জেরিল। ট্রানটরে এই প্রথম?
হ্যাঁ, মি. জেরিল।
অনুমান করেছিলাম। জেরিল আমার ফার্স্ট নেইম। মনটা কবিসুলভ হলে ট্র্যানটর ভালো লাগবে না কারো। অবশ্য ট্রানটরবাসীরাও কখনো আসে না এখানে। পছন্দ করে না ওরা জায়গাটা। বিরক্তি বোধ করে।
বিরক্তি বোধ করে!–ভাল কথা, আমার নাম গাল। বিরক্তি বোধ করে কেন? গ্রহটা তো অসাধারণ।
যদি আপনি জন্ম নেন একটা ছোট্ট ঘরে, বেড়ে ওঠেন করিডরে, কাজ করেন একটা সেলে আর ছুটি কাটান লোক বোঝাই কোনো সান রুমে, সেক্ষেত্রে মাথার ওপর খোলা আকাশ ছাড়া কিছু নেই এমন জায়গায় এলে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যেতে পারে আপনার। সন্তানের বয়েস পাঁচ বছর হলে বছরে একবার করে তাদের এখানে নিয়ে আসে ট্রানটরবাসীরা। জানি না এতে কোনো উপকার হয় কিনা বাচ্চাগুলোর। প্রথম দিকে তো হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো চেঁচাতে থাকে। মায়ের দুধ ছেড়ে দেবার পর থেকেই ওদের এখানে আনা শুরু করা উচিত, আর সেটা সপ্তাহে একবার করে।