অফিসারের সাদা ইউনিফর্মের আস্তিনে এম্পায়ার-এর মহাকাশযান এবং সূর্যের নকশা আঁকা।
গাল বলল, আমি কি একটু থাকতে পারি না? ট্র্যানটরটা দেখতে চাই আমি।
অফিসার মৃদু হাসলেন। গাল লজ্জা পেল একটু। আঞ্চলিক উচ্চারণে কথা বলার কারণেই ভদ্রলোক হাসলেন বলে মনে হলো তার।
অফিসার বললেন, সকালের মধ্যেই ট্রানটরে ল্যাণ্ড করব আমরা।
মানে, আমি স্পেস থেকে দেখতে চাই গ্রহটাকে।
ওহ্ সরি, মাই বয়। এটা স্পেস-ইয়ট হলে সে-ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু সানসাইডে স্পিন করে নামছি আমরা। তুমি নিশ্চয়ই একই সঙ্গে অন্ধ, দগ্ধ আর
রেডিয়েশনে ক্ষত-বিক্ষত হতে চাও না?
অগত্যা ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াল গাল।
অফিসার পেছন থেকে বলে উঠলেন, এখান থেকে ট্র্যানটরকে কেবল ধূসর আর আবছা দেখাবে। ট্রানটরে নেমে স্পেস-টুরে গেলেই তো পারেন। বেশ সস্তা কিন্তু।
ফিরে তাকাল গাল। পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ, শুকনো গলায় বলল শুধু।
মনঃক্ষুণ্ণ হওয়াটা যে ছেলেমানুষি, তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু ছেলেমানুষিতে তো শুধু বাচ্চাদেরই পায় না, বড়দেরও পায়। গালের গলার কাছে কী যেন দলা পাকালো। জীবনের বিশালতা নিয়ে, তার সমস্ত বিস্ময় নিয়ে, চোখের সামনে ট্র্যানটরকে বিস্তৃত হয়ে পড়ে থাকতে সে কখনও দেখেনি। ভাবেনি, আরও বেশ কিছুক্ষণ ওকে অপেক্ষা করতে হবে।
.
দুই
শিপটি অবতরণ করল বিচিত্র ধরনের কিছু শব্দের মধ্যে। ধাতব গা কেটে সরে যাওয়া বায়ুমণ্ডলের দূরবর্তী হিসহিস, সংঘর্ষজনিত তাপ সামাল দেয়া কণ্ডিশনারগুলোর অবিরাম গুনগুন, গতি মন্থরে ব্যস্ত এঞ্জিনগুলোর চাপা, ভারি গুম গুম। সেই সঙ্গে রয়েছে ডিবার্কেশন রুমগুলোয় জড়ো হওয়া নারী-পুরুষের সম্মিলিত কণ্ঠ আর শিপের লম্বা অক্ষ বরাবর ব্যাগেজ, মেইল এবং অন্যান্য মালামাল তোলায় ব্যস্ত হয়েস্টগুলোর ধুপধাপ। মালামালগুলো পরে আনলোডিং প্লাটফর্মে সরিয়ে নেয়া হবে।
হালকা একটা ঝাঁকি অনুভব করল গাল। অর্থাৎ এই মুহূর্ত থেকে শিপটির আর তার নিজস্ব, স্বাধীন গতি রইল না। কয়েক ঘণ্টা ধরেই গ্রহের অভিকর্ষ একটু একটু করে জায়গা করে নিচ্ছিল শিপের অভিকর্ষ সরিয়ে। নমনীয় ফোর্স-ফীল্ডের কারণে ডিবার্কেশন রুমগুলো দুলছে মৃদু গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স-এর পরিবর্তনশীল ডিরেকশানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে যেন নিজেদের। হাজার হাজার যাত্রী ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল রুমগুলোয়। এবার তারা বাঁকা র্যাম্প ধরে বিশাল, মুখ ব্যাদান করা লকগুলোর দিকে এগোল ধীরে ধীরে।
গালের মালপত্র সামান্য। একট ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চটপট এবং দক্ষতার সঙ্গে খুলে আবার বন্ধ করে দেয়া হল সেটা। ভিসা পরীক্ষা করে সীল মেরে দেয়া হল। ও নিজে এদিকে কোনো নজরই দিল না।
এই তাহলে ট্রানটর! ওর বাড়ি যেখানে, সেই সিন্যাক্স গ্রহের চেয়ে বাতাসটা একটু ভারি, অভিকর্ষও সামান্য বেশি। অবশ্যি অভ্যস্ত হয়ে যেতে তেমন সময় লাগবে না। তবে এই বিশালত্বের সঙ্গে নিজেকে সে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে কিনা সেটাই চিন্তার বিষয়।
ডিবার্কেশন রুমটা তো রীতিমতো অসাধারণ। ছাদটা প্রায় হারিয়েই গেছে উঁচুতে। কল্পনার চোখে গাল প্রায় দিব্যি দেখতে পেল, সেই বিশালতার নিচে মেঘ জমেছে। মুখোমুখি কোনো দেয়াল দেখতে পেল না সে। শুধু মানুষ আর ডেস্ক, আর এক সময় দূরে ঝাপসা হয়ে হারিয়ে যাওয়া একবিন্দুমুখী মেঝে।
ডেস্কের লোকটা কথা বলে উঠেছে ফের। তার গলায় ঈষৎ বিরক্তি। লোকটা বলল, এগিয়ে যান, ডরনিক। ওর নামটা ভুলে যাওয়ায় ভিসা খুলে দেখে নিতে হয়েছে তাকে।
গাল জিগ্যেস করল, কো-কোনদিকে-
কিন্তু ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, বুড়ো আঙুল ঝাঁকিয়ে লোকটা বলল, ডাইনে অথবা বাঁয়ে তিন নম্বর বাঁকে ট্যাক্সি পাবেন।
গাল এগোয়; দেখে ওপরে শূন্যে, জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা রয়েছে, ট্যাক্সি। যে কোনো দিকের জন্য।
গাল সরে যেতেই কে-জানে-কোত্থেকে একজন এগিয়ে এল, তারপর ডেস্কটার সামনে এসে দাঁড়াল। ডেস্কের লোকটা মুখ তুলে তাকাল। মাথা ঝাঁকাল মৃদু। উত্তরে আগন্তুকও মাথা ঝাঁকাল, তারপর অনুসরণ করল প্রবাসী যুবকটিকে।
নিজেকে একটা রেলিং-এর সামনে আবিষ্কার করল গাল। ছোট্ট এক সাইনে লেখা, সুপারভাইজার। কিন্তু সাইন নির্দেশিত সুপারভাইজার লোকটা মুখ তোলে না। শুধু জিগ্যেস করে, কোথায় যাবেন?
গাল ইতস্তত করতে থাকে। ও নিজেই ঠিক নিশ্চিত নয় এ-ব্যাপারে। কিন্তু জবাব দিতে এমনকি কয়েক সেকেণ্ড দেরি করার অর্থ ওর পেছনে লোকের লাইন পড়ে যাওয়া।
মুখ তুলে তাকাল সুপারভাইজার, কোথায় যাবেন?
গালের হাতে টাকা-কড়ি বিশেষ কিছু নেই। তবে মাত্র এক রাতের ব্যাপার, তারপরই সে কাজ পেয়ে যাচ্ছে। সে হালকা চালে বলে, যে-কোনো একটা ভালো হোটেল।
সুপারভাইজার লোকটা ভাবলেশহীনের মতো বলে, সবগুলোই ভালো, নাম বলুন।
গাল মরিয়া হলে বলে উঠল, সবচেয়ে যেটা কাছে।
একটা বোতাম স্পর্শ করল সুপারভাইজার। আলোর একটা সরু রেখা তৈরি হল মেঝে বরাবর। বিভিন্ন রঙে আর শেডে কখনো উজ্জ্বল, কখনো নিভু নিভু হয়ে আসা অন্য অনেক রেখার মধ্যে মোচড় খেতে লাগল সেটা। একট টিকেট ধরিয়ে দেয়া হল গালের হাতে। হালকা দীপ্তি ছড়াচ্ছে সেটা।