… নিঃসন্দেহে তার সবচেয়ে বড় অবদান মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস বা সাইকোহিস্ট্রির ক্ষেত্রে। সেলডন যখন বিষয়টিতে হাত দেন তখন এটা ছিল নিতান্তই কিছু অস্পষ্ট, স্বতঃসিদ্ধ ধারণার একটি সমষ্টি মাত্র। কিন্তু সাইকোহিস্ট্রিকে তিনি একটি একটি নিগূঢ়, পরিসংখ্যান-নির্ভর বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে যান।…
… গাল ডরনিকের লেখা জীবনীটিকেই এখন পর্যন্ত তাঁর জীবন সম্পর্কে সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ বলে গণ্য করা হয়। মহান এই গণিতজ্ঞের মৃত্যুর দুবছর আগে তার সঙ্গে দেখা হয় যুবক ডরনিকের। সেই প্রথম সাক্ষাতের কাহিনী…
-ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা।*
——–
* এখানে ব্যবহৃত ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকার সমস্ত উদ্ধৃতি প্রকাশকদের অনুমতিক্রমে ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা পাবলিশিং কোং, টার্মিনাস কর্তৃক ১০২০ এফ. ই.-তে প্রকাশিত ১১৬তম সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে।
.
নাম তার গাল ডরনিক। নেহাতই এক গাঁয়ের ছেলে বলা যেতে পারে ওকে, কারণ এর আগে ট্রানটর দেখেনি সে। অর্থাৎ কিনা, চর্মচক্ষে। হাইপার-ভিডিওতে তো কতবারই দেখেছে। কোনো রাজকীয় অভিষেক বা কোনো গ্যালাকটিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাভার-করা অসাধারণ ত্রিমাত্রিক খবরেও দেখেছে মাঝে মধ্যে।
যদিও ওর সারা জীবন কেটেছে সিন্যাক্স-এ, কিন্তু রু ড্রিফট-এর প্রান্তে একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণরত এই গ্রহটি সভ্যতার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিল না মোটেই। সত্যি কথা বলতে কী, সে-সময়ে গ্যালাক্সির কোনো অংশই অবহেলিত ছিল না।
গ্যালাক্সির দুই কোটি পঞ্চাশ লক্ষ গ্রহে তখন মানুষের বাস। এর মধ্যে একটিও গ্রহ নেই যেটি এম্পায়ার-এর প্রতি অনুগত নয়। এবং গত পঞ্চাশ বছর ধরে ট্রানটরই এম্পায়ার-এর রাজধানী হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।
গালের জন্য এবারের এই ভ্রমণ নিঃসন্দেহে তার নবীন শিক্ষা জীবনের চূড়ান্ত পর্ব।
মহাশূন্যভ্রমণ একবারে নতুন নয় তার কাছে। সুতরাং এটাকে স্রেফ একটা আকাশযাত্রা হিসেবে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না ওর। অবশ্যি ওর দৌড় সিন্যাক্স-এর একমাত্র উপগ্রহ পর্যন্ত। গবেষণাপত্রের জন্য উল্কা-পতনের মেকানিক্স সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়েছিল সে উপগ্রহটায়। কিন্তু তাতে কী? পাঁচ মাইলের মহাশূন্যভ্রমণও যে কথা, কয়েক আলোকবর্ষ ভ্রমণও ঐ একই কথা।
হাইপার-স্পেসের ভেতর দিয়ে জাম্প-এর জন্য শরীরটা একটু শক্ত করে ফেলল সে। আন্তঃগ্রহ ভ্রমণের জন্য অবশ্যি এ-ধরনের জাম্পের প্রয়োজন হয় না। অনেকদিন থেকেই চলে আসছে জাম্পের ব্যবহার। সম্ভবত অনন্তকাল ধরেই চলবে। কারণ, এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে যাবার এটাই কার্যকর পদ্ধতি। সাধারণ মহাশূন্যে চলাচলের জন্য স্রেফ আলোর গতি হলেই চলত (মানব ইতিহাসের সেই বিস্মৃত উষালগ্নের অল্প যে কটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এখনো টিকে আছে, এটি তার অন্যতম); কিন্তু তাতেও সবচেয়ে কাছের বসতিতে পৌঁছুতে কয়েক বছর লেগে যেত। হাইপার-স্পেস মহাশূন্য নয়, সময়ও নয়; বস্তু নয়, শক্তিও নয়; কিছু নয়, আবার কিছু না-ও নয়। গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে কয়েক মুহূর্তের বেশি সময় লাগে না এই হাইপার-স্পেসের ভেতর দিয়ে।
সামান্য ভীতির একটা কুণ্ডলী পাকানো অনুভূতি পেটের মধ্যে নিয়ে প্রথম জাম্প এর জন্য অপেক্ষা করে রইল গাল। এবং সামান্য একটু ঝাঁকিতে শেষ হয়ে গেল জাম্পটা। শরীরের ভেতর ছোট্ট একটা ঝাঁকিও সে অনুভব করেছে কিনা সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হবার আগেই থেমে গেল। ব্যস, ঐ পর্যন্তই।
এরপর ওর অনুভূতি জুড়ে রইল শুধু ১২,০০০ বছরের ইম্পেরিয়াল উন্নতির নির্লিপ্ত, শীতল ফলশ্রুতি এই প্রকাণ্ড ও চকচকে মহাশূন্যযানটি আর সে নিজে, যার থলেতে রয়েছে গণিতশাস্ত্রে সদ্য অর্জিত একটা ডক্টরেট ডিগ্রী আর মহান হ্যারি সেলডনের আমন্ত্রণ- ট্রানটরে গিয়ে বিশাল এবং কিছুটা রহস্যময় সেলডন প্রজেক্টে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ।
জাম্প-এর ব্যাপারে হতাশ হবার পর গাল অপেক্ষা করছে ট্রানটর দেখার জন্য। ভিউরুমে ঢু মারল সে বার বার। পূর্বঘঘাষিত সময় অনুযায়ী স্টীলের শাটারগুলো তুলে দেয়া হয়; প্রতিবারই সময়মত গিয়ে হাজির হয় গাল। উপভোগ করে তারার চোখ ধাঁধানো দীপ্তি; চলার পথে ধরা পড়ে চিরতরে স্থির হয়ে যাওয়া জোনাকি পোকার দানবীয় ঝাঁকের মতো নক্ষত্রপুঞ্জের অবিশ্বাস্য, অস্পষ্ট সমাবেশ। একবার শিপের পাঁচ আলোকবর্ষের মধ্যে একটা গ্যাসীয় নীহারিকার ঠাণ্ডা, নীল-সাদা ধোঁয়া দেখা গেল; জানালার ওপর সে-ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল পাতলা দুধের মতো, ঘর ভরে গেল বরফ-সাদা আলোয়। দুঘণ্টা পর চোখের আড়ালে হারিয়ে গেল সেটা, আরেকটা জাম্পের পর।
প্রথম দেখায় ট্রানটরের সূর্যটাকে মনে হল কঠিন, সাদা একটি বিন্দুর মতো। একইরকম অগুনতি বিন্দুর মধ্যে সেটা নজরেই পড়েনি বলতে গেলে। চেনা গেল নেহাত শিপের গাইড দেখিয়ে দিল বলে। গ্যালাকটিক সেন্টারের এখানটায় তারার সংখ্যা একটু বেশি। কিন্তু প্রতিটি জাম্পের পর সূর্যটা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হল আশ-পাশের সবগুলোকে ঔজ্জ্বল্যে এবং বিশালতায় স্নান করে দিয়ে।
একজন অফিসার এসে বললেন, ট্রিপের বাকি সময়টা ভিউ-রুম বন্ধ থাকবে। নামার জন্য তৈরি হোন।