কোন গ্রহটা ঠিক করা হয়েছে, মাই লর্ড, সেলডন নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন।
ওটার নাম সম্ভবত টার্মিনাস, শেন জবাব দিলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ডেস্কের ওপর পড়ে থাকা কাগজগুলো আঙুলের ডগা দিয়ে তুলে এমনভাবে ধরলেন যাতে সেগুলো সেলডনের দিকে ফিরে থাকে। গ্রহটা জনমানবশূন্য, তবে পুরোপুরি বাসযোগ্য। স্কলারদের প্রয়োজনমত গড়ে তোলারও উপযুক্ত একদম। তবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন।
সেলডন বাধা দিলেন, গ্রহটা গ্যালাক্সির একেবারে প্রান্তসীমায়, স্যার।
বললাম তো, খানিকটা বিচ্ছিন্ন। আপনার অখণ্ড মনোযোগের জন্যে সুবিধে হবে। জলদি, মাত্র দুমিনিট সময় আছে আপনার হাতে।
সেলডন সে-কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, এ-ধরনের ট্রিপের জন্যে তৈরি হতে বেশ সময় লাগবে আমাদের। প্রকল্পটার সঙ্গে বিশ হাজার পরিবার জড়িত।
সময় দেয়া হবে আপনাকে।
এক মুহূর্ত ভাবলেন সেলডন। শেষ মিনিটটিও ফুরিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলে উঠলেন, আমি নির্বাসনই গ্রহণ করলাম।
গালের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল সেলডনের কথা শুনে। প্রচণ্ড একটা সুখের অনুভূতি ওর মনের সমস্ত অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। মৃত্যুর হাত থেকে পার পেয়ে কার-ই বা তা না হবে! তবুও, এই প্রবল স্বস্তির মধ্যেও, সে এই কথাটা ভেবে দুঃখ পেল যে, সেলডন হেরে গেলেন।
.
আট
কয়েকশো মাইল লম্বা, আঁকাবাঁকা টানেলগুলো ধরে ট্যাক্সি ছুটে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে। বেশ কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকার পর গাল নড়েচড়ে উঠল।
বলল, কমিশনারকে আপনি যা বললেন তা কি সত্যি? আপনাকে মেরে ফেললে পতনটা কি সত্যিই ত্বরান্বিত হবে?
সেলডন জবাব দিলেন, সাইকোহিস্টোরিক ফাইণ্ডিংস সম্পর্কে আমি কখনো মিথ্যে কথা বলি না। তাতে অন্তত এই ব্যাপারে কোনো উপকারও হতো না। শেন নিউ আই স্পোক দ্য টুথ। লোকটা খুব ঝানু পলিটিশিয়ান। আর পলিটিশিয়ানদের, তাদের কাজের প্রকৃতি অনুসারেই, সাইকোহিস্টোরিক টুথ সম্পর্কে সহজাত অনুভূতি থাকতে হয়।
তাহলে কি আপনার নির্বাসন মেনে নেবার দরকার ছিল?
গালের এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না সেলডন।
অবশেষে ওরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি খুঁড়ে বেরুল, গালের শরীরের সমস্ত পেশী যেন অসাড় হয়ে এল। ট্যাক্সি থেকে তাকে একরকম ধরেই নামাতে হল। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। সূর্য বলে কিছু যে থাকতে পারে, গাল প্রায় ভুলতেই বসেছিল। অবশ্যি বিশ্ববিদ্যালয়টা উন্মুক্ত নয়। দালানগুলো দানবীয় আকারের গম্বুজে ঢাকা। গম্বুজগুলো কাঁচ আবার ঠিক-কাঁচ-নয় এমন কিছু দিয়ে তৈরি। এবং পোলারাইজড। ফলে, জ্বলন্ত নক্ষত্রটির দিকে সরাসরি তাকাতে কোনো অসুবিধে হলো না গালের। তাই বলে আলোটা কিন্তু নিপ্ৰভ নয়। যতদূর দৃষ্টি যায়, ধাতব দালানগুলোর ওপর আছড়ে পড়ছে সেই আলো।
ট্রানটর-এর বাকি অংশের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারগুলো কঠিন ইস্পাত ধূসর নয়। বরং বেশ খানিকটা রুপোলি। ধাতব দীপ্তিটা অনেকটা হাতির দাঁতের মতো সাদা।
সেলডন বলে উঠলেন, মনে হচ্ছে সৈন্য।
কী? নীরস মাটিতে চোখ নামিয়ে আনতেই গাল দেখতে পেল একটু দূরে একজন সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে আছে।
দুজনে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কাছের একটা প্রবেশ পথ থেকে উদয় হল এক মৃদু-কণ্ঠ ক্যাপ্টেন।
জিগ্যেস করল, ড. সেলডন?
হ্যাঁ।
আমরা আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। এখন থেকে আপনি এবং আপনার লোকজন মার্শাল ল-র আওতাভুক্ত থাকবেন। আপনাকে জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে আমাকে যে, টার্মিনাস-এর উদ্দেশে রওনা হবার প্রস্তুতির জন্যে ছমাস সময় পাবেন আপনি।
ছমাস! চেঁচিয়ে উঠল গাল। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল সে; কিন্তু সেলডনের আঙুলের হালকা চাপ অনুভব করল সে তার কনুই-এর ওপর।
চলে গেল লোকটা। গাল সেলডনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ছমাসের মধ্যে কী করে সম্ভব? কী করা যাবে এই অল্প সময়ের মধ্যে? এটা খুন ছাড়া আর কিছু নয়, তবে একটু ধীরে ধীরে এই যা তফাৎ।
ধীরে, ধীরে। আগে অফিসে চল।
অফিসটা তেমন বড় নয়। তবে সম্পূর্ণ স্পাই প্রুফ। তার চেয়ে বড় কথা, ঘরটা যে স্পাই প্রুফ সেটা ধরারও কোনো উপায় নেই। ঘরটির ওপর ছোঁড়া স্পাই বিম সন্দেহজনক কোনো নীরবতা অথবা আরো বেশি সন্দেহজনক কোনো স্ট্যাটিক ফীল্ড পায় না এখানে। তার বদলে সেটা বিভিন্ন কণ্ঠে এবং সুরে, বিশাল এক নির্দোষ শব্দভাণ্ডার থেকে তৈরি করা উদ্দেশ্যবিহীন কিছু কথাবার্তা রিসিভ করে।
এবার শোন, বেশ আয়েশ করে চেয়ারে বসে সেলডন বললেন, ছমাসই যথেষ্ট।
বুঝতে পারছি না, কীভাবে।
তার কারণ, মাই বয়, আমাদের এই ধরনের কোনো পরিকল্পনায় বিপক্ষের অ্যাকশন আমাদেরই চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। তোমাকে তো আগেই বলেছি, শেন-এর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ওপর যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে তা ইতিহাসে অন্য কোনো মানুষের ওপর করা হয়নি। আমাদের নিজেদের পছন্দমাফিক সময় এবং পরিস্থিতি তৈরি হবার আগ পর্যন্ত কিন্তু বিচারটা শুরু হতে দেয়া হয়নি।
কিন্তু আপনি কি ঠিক করতে পারতেন–
টার্মিনাসেই নির্বাসনে যাব কিনা? কেন নয়? তিনি তাঁর ডেস্কের একটা বিশেষ স্থান আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই তাঁর পাশে দেয়ালের সামান্য অংশ সরে গেল। ব্যাপারটা শুধু তার আঙুলের সাহায্যেই সম্ভব, শুধু তার আঙুলের বিশেষ প্রিন্ট প্যাটার্নই নিচের স্ক্যানারটা সক্রিয় করে তোলে।