প্রঃ এম্পায়ার যে আগের মতোই শক্তিশালী রয়েছে এখনো কি সেটা সবার কাছে স্পষ্ট নয়?
উঃ শক্তির একটা বাহ্যিক রূপ আপনার চারপাশে বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে যেন চিরকালই এই অবস্থা বজায় থাকবে। কিন্তু মি. অ্যাডভোকেট, ঝড়ে দু টুকরো হওয়ার আগের মুহূর্তেও কিন্তু পচা একটা গাছের গুঁড়িকে বরাবরের মতো শক্তিশালী এবং অক্ষতই দেখায়। ঠিক এই মুহূর্তেও এম্পায়ার-এর ডালপালার ভেতর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে। সাইকোহিস্ট্রির কান দিয়ে শুনুন, আপনিও ভাঙনের শব্দ শুনতে পাবেন।
প্রঃ (দ্বিধাগ্রস্তভাবে) ড. সেলডন, আমরা এখানে বক্–
উঃ (দৃঢ়তার সঙ্গে) এম্পায়ার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হবে এর যত ভাল জিনিস। এর পুঞ্জীভূত জ্ঞান ধ্বংস হয়ে যাবে। যে শৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তা-ও নষ্ট হয়ে যাবে। আন্তঃনাক্ষত্রিক যুদ্ধ চলবে অনন্তকাল ধরে। ধসে পড়বে আন্তঃনাক্ষত্রিক বাণিজ্য। জনসংখ্যা কমে যাবে। গ্যালাক্সির মূল অংশের সঙ্গে গ্রহগুলোর যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যাবে- সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা দাঁড়াবে ঠিক এ-রকম।
প্রঃ (অখণ্ড নীরবতার মধ্যে একটা মৃদু কণ্ঠ) চিরকালের জন্য?
উঃ সাইকোহিস্ট্রি শুধু এই পতন সম্পর্কেই নয়, পতন পরবর্তী অন্ধকার যুগ সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম। জেন্টেলমেন, কিছুক্ষণ আগেই বলা হয়েছে এই এম্পায়ার বারো হাজার বছর ধরে টিকে আছে। আসন্ন অন্ধকার যুগটি বারো নয়, ত্রিশ হাজার বছর স্থায়ী হবে। একটি সেকেণ্ড এম্পায়ার এর উত্থান হবে ঠিকই, কিন্তু সেই দ্বিতীয় সাম্রাজ্য এবং আমাদের সভ্যতার মাঝখানে থাকবে এক হাজার প্রজন্মের দুঃখগ্রস্ত মানবগোষ্ঠী। একে রুখতেই হবে আমাদের।
প্রঃ (কিছুটা ধাতস্থ হয়ে) আপনি স্ববিরোধী কথা বলছেন। খানিক আগেই আপনি বলেছেন যে, ট্রানটর-এর ধ্বংস আপনি রুখতে পারবেন না; অতএব, সম্ভবত এম্পায়ার-এর তথাকথিত পতনটাও ঠেকাতে পারবেন না।
উঃ পতনটা আমরা ঠেকাতে পারব সেকথা আমি এখনো বলছি না। কিন্তু পতনের পর থেকে সেকেণ্ড এম্পায়ার গজিয়ে ওঠার মাঝখানে যে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, তার মেয়াদটা কমিয়ে আনার সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি, জেন্টেলমেন, অরাজক পরিস্থিতির মেয়াদ ত্রিশ হাজার বছর থেকে কমিয়ে এক হাজার বছরে নিয়ে আসা সম্ভব, যদি আমার দলটিকে কাজ করতে দেয়া হয়। আমরা ইতিহাসের একটি ক্রান্তিলগ্নে বাস করছি। ছুটন্ত বিশাল ঘটনাপুঞ্জকে সামান্য একটু সরিয়ে দিতে হবে এর পথ থেকে সামান্য একটু। এই সরাটা বেশি হবার উপায় নেই, তবে মানব ইতিহাস থেকে উনত্রিশ হাজার বছরের যন্ত্রণা উপশমের জন্য এটাই হয়ত যথেষ্ট।
প্রঃ কাজটা আপনি কীভাবে করতে চান?
উঃ জাতির জ্ঞানকে বাঁচিয়ে রেখে। মানবজ্ঞানের সমষ্টি একজন লোকের নাগালের বাইরে; এক হাজার লোকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের সমাজ কাঠামো ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ভেঙে লক্ষ লক্ষ টুকরো হয়ে যাবে। যা জানা দরকার তার অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দিকগুলোর অনেকটাই জানবে একজন লোক। অসহায় এবং অকেজো হয়ে পড়বে তারা নিজেদের দ্বারাই। অর্থহীন হয়ে পড়া খণ্ড খণ্ড জ্ঞান অগ্রসর হতে পারবে না। প্রজন্মের মধ্যেই হারিয়ে যাবে প্রজন্মের জ্ঞান। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা যদি সব জ্ঞানের এক বিরাট সারাংশ তৈরি রাখি, তা কখনোই হারাবে না। আগামী প্রজন্ম গড়ে উঠবে এর ওপর ভিত্তি করেই এবং নতুন করে এসব জ্ঞান তাদের আবার আবিষ্কার করতে হবে না। এক সহস্রাব্দ ত্রিশ সহস্রাব্দের কাজ করবে।
প্রঃ এসব–
উঃ এই হচ্ছে আমার প্রজেক্ট। তাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে আমার ত্রিশ হাজার লোক একটা ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা তৈরির কাজে মন-প্রাণ ঢেলে দেবে। কাজটা তারা তাদের জীবদ্দশায় শেষ করে যেতে পারবে না। এমনকি আমিও কাজটা ভাল করে শুরু হল কিনা তা দেখে যেতে পারব না। কিন্তু ট্রানটর ধ্বংস হতে হতে কাজটা শেষ হয়ে যাবে। এবং বিশ্বকোষটার কপি গ্যালাক্সির প্রধান সব কটা লাইব্রেরীতে থাকবে।
চীফ কমিশনারের হাতুড়িটা উঠল এবং পড়ল। হ্যারি সেলডন কাঠগড়া ত্যাগ করে শান্তভাবে গালের পাশে এসে বসলেন। মৃদু হেসে জিগ্যেস করলেন, নাটকটা কেমন লাগল?
গাল জবাব দিল, আপনি বাজিমাৎ করে দিয়েছেন, কিন্তু এখন কী হবে?
বিচার মুলতবি ঘোষণা করবে ওরা। তারপর আমার সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত আপোষরফায় আসা যায় কিনা সেই চেষ্টা করবে।
কী করে বুঝলেন?
সেলডন বললেন, আই উইল বি অনেস্ট। আমি জানি না। ব্যাপারটা নির্ভর করছে চীফ কমিশনারের ওপর। বেশ কয়েক বছর ধরে স্টাডি করেছি আমি লোকটাকে। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি তার কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি। কিন্তু সাইকোহিস্টোরিক ইকুয়েশনে মাত্র একজন লোকের প্রবণতা বা খেয়াল ঢোকানোটা যে কত ঝুঁকিপূর্ণ, তা তো তুমি জানোই। তবুও আমি আশাবাদী।
.
সাত
অ্যাভাকিম এগিয়ে এসে গাল-এর উদ্দেশে মাথা ঝাঁকিয়ে সেলডনের কানের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। বিচার মুলতবির ঘোষণা শোনা গেল।
পরদিনের শুনানিটা হলো একেবারে ভিন্ন ধরনের। কমিশনের পাঁচ সদস্যের সঙ্গে হ্যারি সেলডন আর গাল ছাড়া কেউ নেই। পাঁচ বিচারক আর দুই অভিযুক্ত এই টেবিলে বসা। তাঁদের মধ্যে দূরত্ব সামান্যই। এমনকি সিগারও অফার করা হলো ওঁদের। রঙধনুর মতো সাতরঙা প্লাস্টিকের তৈরি সিগারের বাক্সটা দেখলে মনে হয় সেটার ওপর দিয়ে কুলকুল করে পানি বয়ে যাচ্ছে। অবশ্যি হাত দিলে শুকনো, শক্ত প্লাস্টিকের স্পর্শে ভুল ভাঙে।