উঃ করছি।
প্রঃ তাহলে দেখা যাক, কীভাবে। ড. সেলডন, ভবিষ্যৎ কি পরিবর্তন করা যায়?
উঃ অবশ্যই। আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই আদালত কক্ষ বিস্ফোরিত হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। যদি হয় তাহলে ভবিষ্যৎ কিছু ছোট ছোট ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবর্তিত হবে।
প্রঃ আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন, ড. সেলডন। মানব জাতির সামগ্রিক ইতিহাস কি পরিবর্তন করা যায়?
উঃ যায়।
প্রঃ সহজেই?
উঃ না, অনেক সমস্যা মোকাবিলা করে তবেই।
প্রঃ কেন?
উঃ একটি গ্রহের জনগণের সাইকোহিস্টোরিক ট্রেণ্ডের মধ্যে এক বিরাট জড়তা আছে। পরিবর্তিত হওয়ার জন্য এই ট্রেণ্ডকে অবশ্যই সমজড়তাসম্পন্ন কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। হয় সমানসংখ্যক জড়তা দরকার হবে, আর নয়ত, যদি জনগণের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হয়, বেশ দীর্ঘ একটি সময়ের প্রয়োজন হবে। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?
প্রঃ মনে হচ্ছে পারছি। যদি একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ধ্বংসের বিপক্ষে কাজ করে তবে ট্রানটর ধ্বংস হবে না।
উঃ ঠিক।
প্রঃ এক লাখের মতো লোক?
উঃ নো, স্যার। এক লাখ খুবই কম।
প্রঃ আপনি নিশ্চিত?
উঃ ভেবে দেখুন, ট্রানটরের জনসংখ্যা চার হাজার কোটিরও ওপরে। আরো ভেবে দেখুন, এই ধ্বংসের প্রবণতাটা কেবল এই ট্র্যানটরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা গোটা এম্পায়ার জুড়েই বিরাজ করছে। এবং এই এম্পায়ার-এর জনসংখ্যা প্রায় এক কুইন্টিলিয়ন।
প্রঃ ও, আচ্ছা। এক লাখ লোক এবং তাদের বংশধরেরা যদি পাঁচশো বছর পরিশ্রম করে তাহলে সম্ভবত তারা এই প্রবণতাটির পরিবর্তন ঘটাতে পারবে, কি বলেন?
উঃ আমার মনে হয় না। পাঁচশো বছর খুবই কম সময়।
প্রঃ আচ্ছা। সেক্ষেত্রে, ড. সেলডন, আপনার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পাচ্ছি যে, আপনার প্রজেক্টের আওতায় আপনি এক লাখ লোক সংগ্রহ করেছেন। পাঁচশো বছরের মধ্যে ট্রানটরের ইতিহাস পরিবর্তন করার জন্যে সংখ্যাটা অপ্রতুল। অন্য কথায় বলতে গেলে, তারা যত যা-ই করুক না কেন, ট্রানটরের ধ্বংস রোধ করতে পারবে না।
উঃ দুর্ভাগ্যবশত, আপনি ঠিকই বলেছেন।
প্রঃ এবং অন্যদিকে, আপনার এই এক লাখ লোকের কোনো বেআইনী উদ্দেশ্য নেই।
উঃ ঠিক বলেছেন।
প্রঃ (ধীরে ধীরে এবং স্বস্তির সঙ্গে) সেক্ষেত্রে, ড. সেলডন- খুব মন দিয়ে শুনুন, কারণ আমরা একটি সুচিন্তিত জবাব চাইছি- আপনার এই এক লাখ লোকের উদ্দেশ্য কী?
শেষের দিকে অ্যাডভোকেটের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ এবং কর্কশ হয়ে উঠল। ফাঁদে ফেলে সেলডনকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন তিনি। কৌশলে তিনি তাকে এমন জায়গায় ঠেলে নিয়ে গেছেন যে ড. সেলডনের মুখ থেকে কোনো উত্তর বের হবার সম্ভাবনা নেই। মৃদু গুঞ্জন উঠল সারা আদালত কক্ষে। দর্শকদের সারি থেকে সেটা এমনকি কমিশনারদের সারিতেও ছড়াল। লাল-সোনালি পোশাক পরিহিত কমিশনাররা একজন আরেকজনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। শুধু চীফ কমিশনারের মুখে কোনো চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল না। স্থির হয়ে বসে আছেন তিনি একদম।
বিচলিত হননি আরেকজন। তিনি হ্যারি সেলডন। গুঞ্জনটা মিলিয়ে যাবার অপেক্ষা করছেন তিনি।
উঃ সেই ধ্বংসের এফেক্টগুলো কমিয়ে আনা।
প্রঃ ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?
উঃ ব্যাখ্যাটা খুব সরল। ট্রানটরের আসন্ন ধ্বংসটা কিন্তু নিজে কোনো ঘটনা নয়, মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় একটি বিচ্ছিন্ন ব্যাপার মাত্র। একে আপনি বহু শতাব্দী আগে শুরু হওয়া একটা জটিল নাটকের ক্লাইম্যাক্স বলতে পারেন। আর নাটকটা অনবরত খুব দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। জেন্টেলমেন, আমি আসলে গ্যালাকটিক এম্পায়ারের ক্রমবর্ধমান ক্ষয় এবং পতনের কথা বলতে চাইছি।
গুঞ্জনটা এবার ভোঁতা গর্জনে পরিণত হলো। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে চেঁচিয়ে উঠলেন অ্যাডভোকেট, আপনি খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করছেন যে-। তারপরই থেমে গেলেন। কারণ তখনই দর্শকদের সম্মিলিত রাজদ্রোহ শব্দটা বুঝিয়ে দিল যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার প্রয়োজন হয়নি, তারা সবাই ড. সেলডনের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।
চীফ কমিশনার তাঁর হাতুড়িটা আস্তে করে উঠিয়ে ছেড়ে দিলেন। মিষ্টি, নরম ঘণ্টধ্বনির মতো শব্দ উঠল। সেটার প্রতিধ্বনি থিতিয়ে আসতে দর্শকদের কথাও থেমে গেল। লম্বা করে একটা শ্বাস নিলেন অ্যাডভোকেট।
প্রঃ (নাটকীয় সুরে) ড. সেলডন, আপনি কি উপলব্ধি করতে পারছেন যে আপনি এমন একটি এম্পায়ার সম্পর্কে মন্তব্য করছেন যা বিভিন্ন প্রজন্মের নানান উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে বারো হাজার বছর ধরে টিকে আছে এবং যার পেছনে রয়েছে এক কোয়াড্রিলিয়ন লোকের ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা?
উঃ এম্পায়ার-এর বর্তমান অবস্থা এবং অতীত ইতিহাস- দুটো সম্পর্কেই আমি সচেতন। কোনোরকম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন না করেই বলছি, এ ঘরে উপস্থিত যে-কারোর চেয়ে ভাল ধারণা রয়েছে আমার এই এম্পায়ার সম্পর্কে।
প্রঃ এবং তারপরেও আপনি এর ধ্বংসের কথা বলছেন?
উঃ কথাটা বলা হয়েছে ম্যাথমেটিক্সের সাহায্যে। আমি কোনো নৈতিক বিচারের দিকে যাচ্ছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই পরিণতির জন্যে দুঃখবোধ করি। যদি ধরেও নিই যে এম্পায়ার একটা খারাপ জিনিস (আমি অবশ্য তা বলছি না) তাহলেও, এর পতনের পর যে নৈরাজ্য দেখা দেবে সেটা হবে আরো খারাপ। আর এই অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলা করারই অঙ্গীকার করছে আমার প্রজেক্ট। এম্পায়ারের পতন একটি বিশাল ব্যাপার। এবং সেটাকে আর যাই হোক সহজে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। উঠতি আমলাতন্ত্র, পশ্চাৎগামী উদ্যোগ, ঔৎসুক্যের অবদমন- এরকম একশোটা ফ্যাক্টর আছে এর পেছনে। পতনের প্রক্রিয়াটা চলছে, আমি আগেই বলেছি, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এবং এটা এতই বিশাল আর রাজকীয় একটি গতি যে, একে থামান সম্ভব নয়।