“বাবা আমার উপর রেগে গিয়েছেন।”
মা জিজ্ঞেস করলেন কি ঘটেছে। তিনি চুপচাপ সব শুনলেন আর আস্তে করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি ফুঁপিয়ে চলছিলাম। ঐ নীরব পার্কের মধ্যে, যেখানে আর কেউ ছিল না, মা একটা বিস্ময়কর কিছু ঘটালেন। তিনি আমাকে, তার কাঁদুনে ছেলেকে নিরাপত্তাবোধ আর ভালবাসার অনুভূতি দিলেন।
“মা। তোমার কি মনে আছে অনেক আগে তুমি আমাকে কি বলেছিলে?”
“কি বলেছিলাম যেন?”
“তুমি বলেছিলে এখন থেকে শুধু আমরা দুজন থাকব। তুমি বলেছিলে ব্যাপারটা কঠিন হবে কিন্তু আমরা কোনভাবে সামলে নেব।”
“হ্যাঁ আমার মনে পড়েছে,” তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন। এক পর্যায়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। মা আমার কপালে লেপ্টে থাকা ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিলেন।
“আমি তোমার জগতে থাকতে চাই,” আমি বললাম। আমার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গিয়েছে। তিনি গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কোলে করে আমাকে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। পুরোটা পথ আমি কাঁদলাম।
এরপর আর কখনো বাবাকে দেখিনি।
***
এখন একজন জুনিয়র হাইয়ের ছাত্র হওয়ার পরও, আমার সে সময়ের ঘটনা পরিস্কার মনে পড়ে। আমি অনেকজনকে আমার এই অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। অন্যদের মতামত জানতে চেয়েছি।
আমার মনে আছে সেই দিনটির কথা-যেদিন বাবাকে শেষ বারের মত দেখেছিলাম। আকাশ একদম নীল ছিল আর কোন মেঘ ছিল না। মাটিতে প্রত্যেকটা গাছের প্রত্যেকটা পাতার আলাদা আলাদা ছায়া পড়ছিল। মা আর আমি হাত ধরে এলাকার মধ্যে হাঁটছিলাম। বাইরে বেশ গরম ছিল আর আমি অনেক খুশি ছিলাম। আমি আকাশের দিকে চেয়ে আমার চোখ বন্ধ করেছিলাম। চোখের পাতার পেছনটা সূর্যের আলোর কারনে লাল দেখাচ্ছিল। মা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে অনেক অনেক খেলনা আর ছবির বই ছিল। আমার বয়সি অনেক বাচ্চাকাচ্চাও ছিল। কিছুক্ষণ খেলার পর একজন আমার হাত ধরে একটা রুমে নিয়ে গেল। রুমের ভেতর একটা টেবিলে একটা লোক বসে ছিল। আমাকে বলা হল তার সামনের একটা চেয়ারে বসতে।
লোকটা আমাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি তাকে জানালাম যে, বাবা ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। লোকটা মনে হল আমার কথা বুঝতে পারেনি। সে দু হাত ভাঁজ করে একটু হেসে আমাকে আরেকটা প্রশ্ন করল। “তোমার পেছনে যেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি কে?”
আমি পেছনে তাকালাম, কিন্তু কেউ সেখানে ছিল না। মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি লোকটাকে বললাম কেউ তো নেই।
“ও মনে হচ্ছে ওর বাবাকে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে,” মা বলল। তিনি কাঁদছিলেন। “ও আমার কণ্ঠ শুনতে পায়, কিন্তু মনে হচ্ছে না ওর বাবার কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে। যখন ওর বাবা ওর হাত ধরে বা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন মনে হয় না ও কিছু অনুভব করে। সে যদি ওকে কোলে নেয় তাহলে ও পুতুলের মত নিস্তেজ হয়ে যায়।”
“বুঝলাম, লোকটা বলল। তারপর আমার মায়ের সাথে কথা বলে চলল। “তারমানে সহজ কথায় বললে, আপনি আর আপনার স্বামীর মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল, তারপর আপনারা দুজনেই অভিনয় করেছিলেন যে অন্য জন মৃত। একইভাবে আপনারা আপনাদের সন্তানের সাথে কথা বলেছিলেন আর তাকে আপনাদের গল্পের সাথে খেলিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এরপর এই অবস্থা হয়েছে।”
এখন বড় হওয়ার পর আমি বুঝতে পারছি আমার মা আর ডাক্তার অভদ্রলোকের মধ্যে কি কথা হয়েছিল। আমার মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি কিভাবে কি হয়েছিল। মা আমাকে বলেছিলেন বাবা ওখানে আছেন তাই আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কি করছি বুঝতে না পেরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় বাবা।
“কেন তুমি তাকে অনুভব করতে পারছ না?” মা বললেন। “তুমি এই মুহূর্তে তাকে স্পর্শ করছ তো!” হতাশায় ভেঙে পড়ে তিনি কাঁদতে লাগলেন। এক মুহূর্ত পর তিনি আমার কাঁধের উপর দিয়ে তাকালেন এবং কথা বলতে থাকলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না তিনি কার সাথে কথা বলছিলেন।
আমার অবস্থা এরকম হওয়ার পর থেকে এখন আমার বাবা-মায়ের মধ্যে আর কোন সমস্যা নেই। আমি এখনো আমার বাবাকে দেখতে পাই না, কিন্তু মা যখন কাঁদেন তখন অনুভব করতে পারি যে তিনি মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, আমরা একটা সুখি পরিবার। সবাই বলে যে আমি পাকাপাকি রকমের ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছি কিন্তু আমি ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখি না। আমি উপলদ্ধি করেছি যে, এটাই আমি সবসময় চেয়ে এসেছি-আমার বাবা আর মাকে সবসময় একসাথে রাখতে।