আমি এতটা কষ্ট পেয়েছিলাম যে বাকি রাত তাদের কারোর সাথেই আর কথা বলতে পারিনি। আর কখনো আমরা তিনজন এক সাথে সোফায় সময় কাটাতে পারব না। এই নতুন তথ্যটা হজম করতে আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। মা আমার নিস্তব্ধতায় দুশ্চিন্তাবোধ করছিলেন, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। আর আমাকে তাদের যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে।
৪
যতদূর মনে পরে, পরদিন ছিল শনিবার। আকাশ গুমোট হয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হবে। মা কোথাও এক জায়গায় ছিল, বাবা আমার পাশে বসে খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মা নেই, পুরো অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজলাম তাকে। কিন্তু আমি জানতাম যে বাবার সাথে এক রুমে থাকলে মাকে দেখতে পাব না। হয়ত তিনি আমার পাশেই বসে আছেন।– আমি সবগুলো রুম খুঁজে নিজেকে বোঝালাম যে তিনি নেই। হাল ছেড়ে দিয়ে সোফায় বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। অনেকটা সময় আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করে নীরবতা ভাঙব। টিভিতে আমার প্রিয় সুপারহিরোর প্রোগ্রাম চলছিল, কিন্তু আমি এতটা অস্থির হয়ে ছিলাম যে দেখা হচ্ছিল না। বাবা ডান হাত দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলেন।
“আমরা আর মাকে একসাথে দেখতে পাব না…” একসময় ইতস্তত করে বললাম আমি। বাবা আস্তে করে মাথাটা আমার দিকে ঘোরালেন, তার কাঁধগুলো সতর্ক হয়ে উঠেছিল।
“কি বললে তুমি?”
“আমি এখন একবারে শুধু তোমাদের একজনকে দেখতে পাচ্ছি, তুমি আর মা…”
তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল আমি ভুল কিছু করে ফেলেছি। আমি ভয় পাচ্ছিলাম তিনি আমার উপর রেগে উঠবেন, আমার দৌড়ে পালাতে ইচ্ছা হচ্ছিল। পেটের মধ্যে সবকিছু গিট পাকিয়ে যাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম কথাটা আমার গোপন রাখা উচিত ছিল। বাবার তীব্র চাহনির সামনে আমি হাত দিয়ে মুখ ঢাকলাম।
“আমি যখন তোমার সাথে থাকি তখন মাকে আর দেখতে পাই না।”
আমি বার বার একই কথা বলতে থাকলাম। একসময় মনে হল তিনি আমার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছেন। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার কাঁধে হাত রেখে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালেন যেন কিছু জানতে চান।
“সত্যি…এটা সত্যি।” আমি ভয়ে কাঁদছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম বাবা আসলে মাকে ভালবাসেন, আমি একমাত্র সুতো ছিলাম যে তাদের দুই জগতটাকে বেঁধে রেখেছিল। আমি যদি একটা ভাল ছেলে হতাম তাহলে তারা আজীবন একসাথে থাকতে পারতেন-এরকমই আমি ভেবেছিলাম।
বাবা রেগে গিয়েছিলেন কিন্তু আমি আর কিছু বলতে পারছিলাম না। আমি খালি কাঁদছিলাম, আর তাতে তার রাগ আরো বাড়ছিল। তিনি হাত তুলে আমার গালে চড় লাগালেন। আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম। বার বার বলতে লাগলাম আমি কতটা দুঃখিত। আমি জানি আমি একটা খারাপ ছেলে। আমি শুধু চাইছিলাম মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর আমি ভেতরে হারিয়ে যাই। সব দোষ আমারই ছিল। আর আমার বাবা আমাকে ঘৃণা করতেন।
আমি উঠে দৌড়ে রুন্ম থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাবা আমার নাম ধরে ডাকলেন, কিন্তু পেছন পেছন এলেন না। আমি মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। জুতো না পরেই। সিঁড়ি দিয়ে নেমে পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে দৌড়ে এলাকার পার্কের দিকে ছুটলাম। আমি আমার বাবা আর লিভিং রুমের সোফাটাকে এতটাই ভালবাসতাম যে ওগুলোর সামনে আর থাকতে পারছিলাম না। বাবার থাপ্পড় প্রমাণ করে দিয়েছে যে তার আমাকে আর দরকার নেই। দৌড়ানোর সময় আমার পায়ের তলা কেটে গিয়েছিল কিন্তু আমি কিচ্ছু টের পেলাম না।
পার্কে কেউ ছিল না। অন্য বাচ্চারা সম্ভবত বৃষ্টি হতে পারে এই ভয়ে বাসায়ই ছিল। এমনিতে পার্কটা হাসাহাসি হৈচৈতে ভরপুর থাকে। সেদিন স্লাইড আর দোলনাগুলো একদম খালি ছিল। আমার খেলাধুলা করার কোন ইচ্ছা ছিল না, খালি পার্কে আমি আমার একাকীত্ব আরো বেশি করে অনুধাবন করতে পারছিলাম।
স্যান্ডবক্সে বসে আমি আমার পা বালির ভেতর যতটা সম্ভব ঢুকিয়ে দিলাম। আমি শুধু বাবার কথা ভাবছিলাম। আমার মত একটা ছেলেকে তিনি কি করে ভালবাসবেন? গতরাতের লড়াইটা পুরোপুরি আমার দোষ ছিল। আমি যদি একটা ভাল ছেলে হতাম, যেরকম ছেলেরা জামাকাপড়ের উপর না ফেলে পুরো খাবার খেতে পারে, যে ছেলেরা খেলা শেষে সব খেলনা গুছিয়ে রাখতে পারে, তাহলে তারা কখনো লড়াই করতেন না।
বালিটা কালো রঙের আর উষ্ণ ছিল। আমার হাতেপায়ে লেগে গিয়েছিল। পেছন থেকে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকল। মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা শপিং ব্যাগ তার হাত থেকে ঝুলছিল।
“তুমি কি বাবার সাথে এখানে এসেছ?”
একটু হেসে তিনি পার্কে এদিক ওদিক তাকালেন। আমি মাথা নাড়লাম। মা এসে আমার পাশে বসলেন। তার চেহারায় চিন্তিত ভাব।
“তোমার জুতো জোড়া কোথায় ফেলেছ? আর তোমার গাল লাল হয়ে আছে কেন?”
আমি হাত দিয়ে আমার আহত গাল চাকলাম। আমি চাইছিলাম না যে তিনি জেনে যাক বাবা আমার উপর রেগে গিয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম তিনিও আমাকে বকবেন। কিন্তু মা বোধহয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তার ব্যাগ নামিয়ে রেখে দুহাত দিয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।
“কি হয়েছে?” জানতে চাইলেন। তার শরীরে পরিচিত গন্ধ আমাকে শান্ত করে তুলল। আমি কিছুটা ভাল বোধ করতে লাগলাম।