“তাহলে, তুমি তোমার বাবাকে গিয়ে বলতে পার…” তিনি বাবাকে কিছু খারাপ কথা বলার জন্য বললেন। কথাগুলোর কিছু অংশ আমি বুঝতে পারিনি, তাই তিনি আমাকে প্র্যাকটিস করালেন। আমি তখন ছোট ছিলাম ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে বলার জন্য এগুলো খুবই বাজে কথা।
“আমি পারব না! থামো!” আমি তাকে বলেছিলাম, কিন্তু কোন কাজ হল না।
“তুমি তাকে অবশ্যই বলবে! বুঝতে পেরেছ?”
তাই একজন দায়িত্ববান ডাকপিয়নের মত আমি বেডরুম থেকে লিভিং রুমে, আবার লিভিং রুম থেকে বেড রুমে যাওয়া আসা করতে লাগলাম আর তাদের জোর করে শেখানো খারাপ কথাগুলো আদান প্রদান করতে লাগলাম।
প্রতিটা নতুন মন্তব্যর সাথে আমার বাবা-মা আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তাদের চাহনি দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম এই কথার যুদ্ধে আমার অংশগ্রহণের জন্য আমার প্রতি তারা ঘৃণাবোধ করছিলেন। তারা একজন আরেকজনের দিকে চেঁচাচ্ছিলেন না, তারা চেঁচাচ্ছিলেন আমার প্রতি। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন অভিশপ্ত কেউ।
প্রথমদিকে তাদের সাথে কথা বলতে আমার অনেক শক্তি খরচ হচ্ছিল। কিন্তু ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি আস্তে আস্তে সব অনুভূতি হারিয়ে ফেললাম। আমি তাদের কণ্ঠও আর শুনতে পাচ্ছিলাম না।
আমার মুখটা ছিল একটা টেপ রেকর্ডারের মত। রেকর্ড করে রিপ্লে করতাম, আবার রেকর্ড করে আবার রিপ্লে করতাম। কান্না থামাতে পারছিলাম না। আমি আমার বাবা-মা দুজনকেই ভালবাসতাম। আর এসব কথা বলতে হচ্ছিল বলে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছিল আমার।
***
ঘন্টাখানেক পর লড়াই থামল।
আমি চাইছিলাম আমরা সবাই গিয়ে আবার লিভিং রুমের সোফায় একসাথে বসি। কিন্তু ভয়ে প্রস্তাবটা তুলতে পারলাম না। আমি সোফায় বসে অপেক্ষা করছিলাম, আমার বুক ধুকপুক করছিল। বাবা লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমে গিয়েছিলেন মুখ ধুতে। এতে তিনি কিছুটা শান্ত হয়েছিলেন, যদিও তখনও তাকে খানিকটা আপসেট দেখাচ্ছিল।
তিনি যখন ছিলেন না, মা তখন লিভিং রুমে এসেছিলেন। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে তারা আবার যুদ্ধ শুরু করবেন। মা এসে আমার পাশে বসলেন। তাকে খানিকটা উন্মত্ত দেখাচ্ছিল। সোফার কুশনের উপর তার ভারের জন্য আমি খানিকটা তার দিকে কাত হয়ে গিয়েছিলাম।
“আমি দুঃখিত,” তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন। আমি তখন দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আশা করছিলাম যে কোন মুহূর্তে বাবা ফিরে আসবেন আর আমি সাথে সাথে মাকে তার আসার কথা জানাবো। কিন্তু তিনি এলেন না।
মা উঠে কিচেনে চলে গেলেন। তিনি চলে যেতেই, আমি আমার পাশে ম্যাগাজিন উল্টানোর শব্দ শুনতে পেলাম।
বাবা কোন এক সময় ফিরে এসে সোফায় তার নির্দিষ্ট স্থানে বসেছিলেন। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তাকে ঢুকতে দেখতে পাইনি। তিনি সিগারেট খাচ্ছিলেন। সিগারেটের ধোঁয়া আমার ভাল লাগে না। অসুস্থ বোধ হয়। কিন্তু ঐ মুহূর্তের আগ পর্যন্ত আমি সিগারেটের কোন গন্ধ একদম টের পাইনি।
বাবার মুখটা কঠোর হয়ে ছিল।
“এতক্ষন ধরে তোমাকে বলছি, অথচ আমার দিকে তাকাচ্ছ না,” তিনি বললেন। মায়ের মত তিনিও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি নিশ্চিত তার হাতটা আসলেই ছিল। কারন স্পর্শটা উষ্ণ ছিল। আমার অদ্ভুত লাগছিল। অবাক হয়ে ভাবছিলাম আগে কেন তাকে খেয়াল করিনি।
অপেক্ষা করছিলাম মায়ের ফিরে আসার জন্য। অপেক্ষা করতেই থাকলাম করতেই থাকলাম কিন্তু তিনি এলেন না। বাবা আর আমি সোফায় বসে টিভিতে একটা বিচিত্রানুষ্ঠান দেখতে থাকলাম।
“তোমার মাকে একটু জিজ্ঞেস করবে কালকের শিডিউল কি?” বাবা জানতে চাইলেন। তিনি তার প্রশ্নটা এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যাতে আপসেট করার মত কিছু না বলে ফেলেন। আমি উঠে কিচেনে গেলাম।
দরজা খুলে মাকে খুঁজলাম। কিন্তু কেউ সেখানে ছিল না। শুধু কল থেকে পানি পড়ছিল। অ্যাপার্টমেন্টের ডিজাইনটাই এমন ছিল যে, কিচেনে বা অন্য কোথাও হলে লিভিং রুমের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। খুবই অদ্ভুত যে তিনি সেখানে ছিলেন না।
আমি যখন এর মানে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তখন লিভিং রুমে ফিরে দেখি মা সোফায় বসে আছেন। তিনি কিভাবে সেখানে এলেন আমার কোন কোন ধারণা নেই। এক মুহূর্ত আগে যেখানে কেউ ছিল না, সেখানে বসে তিনি এমনভাবে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন যেন অনেকক্ষণ ধরে ওখানে বসে আছেন।
বাবাকে কোথাও দেখা গেল না। কোন অ্যাস্ট্রে না, কোন আধ খাওয়া সিগারেট না, বাতাসে কোন ধোঁয়া না।
আমি হাঁ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, প্রশ্ন করার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম।
“কোন সমস্যা?” তিনি মাথা কাত করে আমাকে প্রশ্ন করলেন।
আমি বুঝতে পারলাম মা এতক্ষন এখানেই বসে ছিলে। আর শুধু মা নয়, তারা দুজনেই এখানে ছিলেন, আমার দু পাশে। কিন্তু আমি তাদের দুজনকে এক সাথে দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আমি দৌড়ে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে সাথে সাথেই আবার ঢুকলাম। এবার মাকে কোথাও দেখা গেল না, সোফার কোন অংশ দেবে পর্যন্ত নেই। কিন্তু বাবাকে তার জায়গায় বসা অবস্থায় দেখতে পেলাম। তখন আমি সব বুঝতে পারলাম।
সোফায় বসে নিজের চোখগুলো কিছুক্ষণ বন্ধ করে রাখলাম। ডানপাশ থেকে আধখাওয়া সিগারেট উধাও হয়ে গেল, বাম পাশে কফি কাপ হাজির হল।
এখন আমি তাদের দুজনকে একইসাথে কথা বলতে শুনতে পারছি না।’ আমার বাবার জগত আর মায়ের জগত একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। যখন এক জগতে আছি, অন্য জগত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমি আর দু জগতের মাঝামাঝি কোথাও নেই। স্রেফ জগত দুটোর মধ্যে যাওয়া আসা করছিলাম-আর তারা ক্রমশ নিজেদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল।