***
সেই সময় আমার বাবা-মা যে যেই জগতে বাস করতেন সেটা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করতাম। তারা আমাকে যা বলেছিলেন তা থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে টিভিতে শোনা ট্রেন এক্সিডেন্টে নিশ্চয়ই তাদের কেউ একজন মারা গিয়েছিলেন। আসলে ব্যাপারটা এখানে একটু জটিল ছিল কারন তারা দুজনেই ভাবতেন অন্যজন ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন।
মনে হচ্ছিল তাদের কারো একজনের কোন আত্মীয়র বাসায় কিছু একটা দিয়ে আসার কথা ছিল। তো তারা ঠিক করলেন রক-পেপার-সিজার খেলবেন এবং যে হারবে সে ট্রেনে করে ঐ আত্মীয়র বাসায় যাবে।
এই অংশের পর তাদের গল্প যার যার দিক থেকে বদলে যায়। মায়ের জগতে, বাবা খেলায় হেরে গিয়ে ট্রেনে চড়েন। আর বাবার জগতে, বাবা নয় বরং মা গিয়েছিলেন আত্মীয়র বাড়িতে।
তারপর ট্রেন দুর্ঘটনাটা ঘটে। আমার বাবা-মায়ের প্রত্যেকেই ভাবেন তারা আমার সাথে একা রয়ে গিয়েছেন।
মা আর বাবার জগতের মধ্যে সংযুক্তিটা ছিল কিছু সেমিট্রান্সপারেন্ট ছবি একত্র করার মত যেখানে দুটোতেই আমি রয়েছি। আমি এই দুই জগতটাকেই একই সাথে একই সময়ে দেখতে পাচ্ছিলাম। এর জন্য আমার গর্ববোধও হত। আমার মনে হত আমি কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি, বাবা মায়ের মধ্যে কোন রকমের কোন লিয়াজোঁ অফিসারের মত দায়িত্ব পালন করছি।
যেমন ধরা যাক, বাবা দরজা খুলে রুমে ঢুকলেন। মায়ের কাছে, যিনি বাবাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না, মনে হতে পারত যে দরজাটা নিজে নিজে খুলে আবার নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আসলে তিনি দরজা খোলা-বন্ধ হওয়া খেয়ালই করতেন না। আমি যদি সেটার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম তাহলে বলতেন, “ও হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, আমি এইমাত্র খেয়াল করলাম।” তখন তিনি বুঝতে পারতেন।
আবার ধরা যাক মা হয়ত কিচেনে থালাবাসন ধছেন। বাবা তাকে কিংবা তিনি কি করছেন তার কোনটাই দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের দুজনের জন্যই যা যা তাদের নিজেদের জগতে ঘটা সম্ভব নয় তা তাদের থেকে অদৃশ্য থাকত।
খাওয়ার সময়, বরাবরের মত তারা আলাদা আলাদাভাবে খেতেন। মা রান্না করতেন, বাবা বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসতেন, আর তারা সেগুলো খেতেন।
“বাবা তুমি কি এই ভাত তরকারি দেখতে পাচ্ছ না?” আমি তার সামনে একটা প্লেট রেখে জানতে চাইতাম। কিন্তু মনে হত তিনি সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। তার চেহারায় বিভ্রান্তি ফুটে উঠত।
মাঝে মাঝে বাবা হয়ত ঘরের কোন এক কোনার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে কথা বলতেন যেন মা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ মা হয়ত তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যেটা বাবা বুঝতে পারছিলেন না। মাও তার কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। আমি তাদের দুজনকেই বলতাম যে ব্যাপারটা আমার কাছে কতখানি অদ্ভুত লাগত।
যখন আমার মনে হত তাদের একজন আসলেই মৃত, তখন অনেক খারাপ লাগত। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার বাবা-মায়ের দুই জগতের মাঝখানে আমি রয়েছি।
প্রথম প্রথম আমার ভয় লাগত, যখন তারা একজন আরেকজনের সাথে কথা বলতে পারতেন না। একটা সময়ে গিয়ে আমার আর সমস্যা হয়নি। আমি সোফায় তাদের মাঝখানে বসে নিরাপদ আর নিশ্চিন্তবোধ করতাম।
কিন্তু যদিও তখন একটা বাচ্চা ছিলাম, তারপরেও বুঝতে পারছিলাম এভাবে আজীবন চলতে পারে না। একসময় না একসময় আমাকে যে কোন একটা জগত বেছে নিতে হত। মনের গভীরে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারছিলাম।
৩
শুরুতে যেরকম ছিল, সেরকম আবার শুরু হল। এক পর্যায়ে বাবা-মা যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধ বলতে কিন্ডারগার্টেনের খেলার মাঠে যেরকম দেখা যায় সেরকম কিছু না।
এক সন্ধ্যায় আমরা তিনজন সোফায় বসে ছিলাম। টিভি দেখছিলাম। আর আমি অটোমেটিকভাবে একজনের কথা আরেকজনের কাছে পুনরাবৃত্তি করছিলাম। এরকম অনেকদিন ধরে হচ্ছে বলে আমি বেশিরভাগ সময়ই কোণ চিন্তা না করে সেগুলো পুনরাবৃত্তি করতাম।
টিভিতে আমার প্রিয় কার্টুনগুলোর একটা হচ্ছিল, আমার সমস্ত মনোযোগ সেটার উপর ছিল। সোফার উপর শুয়ে গালে হাত দিয়ে ছিলাম। এরকম পুরো সোফা জুড়ে থাকাটা মায়ের পছন্দ হল না, আমাকে বললেন এটা খারাপ, কিন্তু আমি তারপরেও ওভাবেই ছিলাম।
হঠাৎ বাবা তার খবরের কাগজটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেললেন। ঐ সময় প্রথম আমি উপলদ্ধি করলাম যে আমার বাবা-মা দুজনেই খারাপ মুডে আছেন। তারা একজন আরেকজনকে আঘাত দিয়ে কথা বলছিলেন কিন্তু আমি সেগুলো বলার সময় মনোযোগ দেইনি।
মা উঠে বেডরুমের দিকে চলে গেল।
“মা তার রুমে চলে গিয়েছে,” আমি বললাম।
“তো কি হয়েছে?” বাবা খেঁকিয়ে উঠল।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম, কার্টুন শো এর কথা ভুলে গেলাম। আমি চাচ্ছিলাম তাদের মিল হয়ে যাক। তারা দুজন আমার দুপাশে না থাকলে আমি সুখি হতে পারছিলাম না।
“অ্যাঁই,” একটু পর বাবা আমাকে বললেন। “যাও গিয়ে তোমার মাকে বল।”
“কি বলব?”
“গিয়ে বল যে সে মরে যাওয়াতে আমি খুশি হয়েছি।”
বাবার মুখটা দেখে ভয় লাগছিল। আমি করতে চাইছিলাম না কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম যে কথাটা মাকে না বললে তিনি হয়ত আমার উপর ক্ষেপে যেতে পারেন। তাই আমি উঠে মায়ের কাছে দৌড়ে গেলাম।
“বাবা বলেছে, তুমি মারা যাওয়ায় সে খুশি। আমাকে বললেন তোমাকে বলতে,” আমি কান্না চেপে বললাম। মা কিছু বললেন না। কাঁদতে শুরু করলেন। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকল। আমি এর আগে কখনো কোন বয়স্ক মানুষকে কাঁদতে দেখিনি, অনেক ভয় পেয়েছিলাম। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম না কি করব।