“শোন, তোমার বাবা মারা গিয়েছে। এখন থেকে আমাদের জীবনটা হবে শুধু তোমাকে আর আমাকে নিয়ে। ব্যাপারটা কঠিন হবে কিন্তু আমরা কোন না কোনভাবে সামলে নেব।”
বিষয়টা বুঝতে আমার সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু মায়ের কণ্ঠস্বর এতটাই সিরিয়াস ছিল যে আমি খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি হতভম্ব হয়ে বসে ছিলাম আর মা বলেছিলেন, “চিন্তা কোর না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তারপর ছোট করে মাথা ঝাঁকিয়ে একটু হাসলেন।
এরপর আমার বাবা আমার দিকে তাকালেন। একদম আমার চোখে চোখ রেখে তাকালেন যেন মায়ের কোন অস্তিত্ব নেই সেখানে।
“আমাদেরকে শক্ত হতে হবে। তোমার মা বেঁচে থাকলে সেটাই চাইত নিশ্চয়ই।”
তখন আমার উপলদ্ধি হল যে তারা কেউ একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছে না। বাবা দেখতে পাচ্ছে না মাকে। মা দেখতে পাচ্ছে না। বাবাকে। দুজনেই ভাবছে সে ছাড়া আর কেউ আমার পাশে বসে নেই।
দুজনের কথা থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে ওদের মধ্যে কেউ একজন নিশ্চয়ই মারা গিয়েছেন। বাবা ভাবছিল মা মারা গিয়েছে আর আমাকে মাকে ছাড়া চলতে শিখতে হবে। অন্যদিকে মা ভাবছিল বাবা মারা গিয়েছে।
দুজনের কেউই একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছিলেন না বা একে অপরের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। শুধুমাত্র আমিই তাদের দুজনকেই দেখতে পাচ্ছিলাম।
২
সে সময় আমার জানা শব্দ ভান্ডার সীমিত ছিল, তাই আমি আমার কথাগুলো পরিস্কারভাবে আমার বাবা-মায়ের কাছে বলতে পারিনি। আমি তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম যে, আমি অন্যজনকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তারা আমার কথা আমলে নেননি।
“বাবা তো ঐ অন্য রুমটায় বসে আছে, মায়ের এপ্রন টেনে বলেছিলাম। তিনি তখন কিচেনে থালাবাসন ধুচ্ছিলেন। বাবা লিভিং রুমের সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।
“ও আচ্ছা, হুম… প্রথম দিকে মা শুধু হালকাভাবে তার মাথা নাড়ছিলেন, কিন্তু আমি যখন বার বার একই কথা বলতে লাগলাম তখন। আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালেন।
“আমি জানি বিষয়টা তোমার জন্য কঠিন,” তিনি বললেন। তাকে চিন্তিত শোনাল। আর আমার মনে হল নিশ্চয়ই আমার মাথার ভেতর কোন সমস্যা হয়েছে, আর এই বিষয়টা হল সেরকম কোন বিষয় যা নিয়ে আমার কথা বলা উচিত না।
তারপরও আমি অনেকবার পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম।
এক সন্ধ্যায় আমরা তিনজন সোফায় বসে ছিলাম। অবশ্যই আমরা তিনজন” দিয়ে আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝাতে চাইছি। আমার বাবা-মা ভাবছিলেন তারা একা আমার সাথে সোফায় বসে ছিল।
“মা নীল রঙের সোয়েটার পরে আছে,” ডান দিকে তাকিয়ে বাবাকে বললাম। তারা দুজনেই আমার দিকে তাকালেন।
“কি বললে?” বাবা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন। আমি তার দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারছিলাম তিনি আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাবোধ করছেন। তিনি নিশ্চয়ই ভাবছিলেন আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি।
“আসলেই! আসলেই মা নীল রঙের সোয়েটার পরে আছে।” অন্যদিকে মাও অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
“আমি তোমাদের দুজনকেই দেখতে পাচ্ছি। বাবা, মা, আমরা সবাই এই রুমের মধ্যে আছি।”
আর তারা দুজনেই আলাদা আলাদাভাবে বাঁকা চোখে তাকালেন আমার দিকে।
এরকম অনেকবার হয়েছে। প্রথম প্রথম তারা ভান করতেন যে তারা আমার কথাগুলো শুনছেন।
একবার এমন হল, আমি স্ন্যাক্সের একটা প্যাকেট খুলতে পারছিলাম, মা কাঁচি খুঁজতে গেলেন।
“তোমার বাবা কাঁচি কোথায় রেখেছে?” ড্রয়ারের জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে অন্যমনস্কভাবে প্রশ্ন করলেন। “আমি খুঁজে পাব এরকম কোথাও রেখে গেলে ভাল করত।”
বাবা পা ভাঁজ করে সোফার উপরে বসেছিলেন। তাকে দেখে মনে হল যে মা রুমের মধ্যে আছেন তা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম কাঁচি কোথায় রেখেছে।
“আমি নিশ্চিত যে কাঁচি কিচেন কেবিনেটের ড্রয়ারে রেখেছিলাম,” তিনি আমাকে বললেন। আমি একই কথা মাকে আবার বললাম, যদিও তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
“বাবা বলছে কিচেন কেবিনেটের ড্রয়ারে আছে। বাবা মাত্রই আমাকে বলল।”
অতপর সেখানেই সেটা পাওয়া গেল। এরকম অনেকবার হল। শেষে বাবা-মা দুজনই আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন।
“আমি বাবাকে দেখতে পাচ্ছি, তার কথাও শুনতে পাচ্ছি।” মাকে তারপরেও বিভ্রান্ত দেখাত, কিন্তু আমার কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিতেন।
“মা এখানেই আছে। তুমি আর আমি একা নই। তুমি যদি মাকে কিছু বলতে চাও তাহলে আমাকে বল, আমি তাকে বলে দিচ্ছি।” আমি যখন বাবাকে এই কথাটা বললাম তিনি খুশি হয়ে হাসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
তখন থেকে আমি তাদের মধ্যে কথা আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা মজার ছিল।
আগের মতই আমরা তিনজন একসাথে সোফায় বসে টিভি প্রোগ্রামগুলো দেখতাম।
“আমার ট্রাভেল শো ভাল লাগে,” মা হয়ত বললেন, আমি সাথে সাথে তার কথাটা বাবাকে জানালাম।
“মা চ্যানেল বদলাতে চায়। ট্রাভেল শো দেখতে চায়।”
“তাকে বল তাকে এই পলিশ শোই দেখতে হবে,” বাবা বললেন, স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই।
“বাবা চ্যানেল বদলাতে চায় না।” কথাটা শুনে মা উঠে কিচেনে চলে গেলেন।
আমি হেসে গড়িয়ে পড়লাম। ব্যাপারটা মজার কারন আমাদের জীবন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছিল। একমাত্র পার্থক্য যেটা ছিল সেটা হল বাবা-মা যদি একে অপরের সাথে কথা বলতে চাইতেন তাহলে আমাকে। মাঝখানে রেখে কথা বলতে হত। আবারও আমার মনে হতে লাগল যে আমরা তিন সদস্যের পরিবার। আর এতে আমি সখি ছিলাম।