মেয়েরা কেউ বলল না যে আমাদের উচিত দরজা খুলে আপুকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা। আপু আমাকে তার মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করে সবাইকে জানিয়েছে যে যদি আমরা রুম থেকে বের হতে পারি তাহলে আমাদের উচিত হবে দ্রুত এখান থেকে পালানো। নাহলে লোকটা আমাদের সবাইকে খুন করবে।
আর আমরা তাই করলাম। সবাই পালিয়ে এলাম। আপুকে মৃত্যু দেবতার সাথে চার নাম্বার রুমে একা ফেলে এলাম।
করিডর দিয়ে হলওয়ের শেষে গিয়ে উপরে যাওয়ার সিঁড়ি পাওয়া গেল। আমাদের স্বাধীনতা যেখানে আটকা পড়ে ছিল সেই বিষণ্ণ রুমগুলো থেকে আমরা অবশেষে মুক্তি পেলাম।
আমি আমার কান্না কোনভাবে আটকাতে পারছিলাম না। একটা ক্রুসসহ নেকলেস আমার গলায় ঝুলছিল। এক হাতে একটা নোটক ধরেছিলাম যেটায় এক মেয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছিল। আমার হাতে আপুর স্মৃতিঃ ওর ঘড়িটা। ঘড়িটা ওয়াটারপ্রুফ ছিল না। পানিতে যখন লুকিয়ে ছিলাম তখন ঘড়িটা নষ্ট হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায়।
সো-ফার
সো : ঝঙ (Significant Other)-এর সংক্ষিপ্ত রূপ
১. গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি (বাবা-মা, বন্ধু ইত্যাদি)
২. স্বামী কিংবা স্ত্রী, প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা
ফার : দূরত্ব
১. বিশাল দূরত্ব
১
এতদিনে আমি কিছুটা বড় হয়েছি। ইলিমেন্টারি স্কুল পার করে ফেলেছি, শিগগিরি জুনিয়র হাইতে উঠবো। তাই এখন অনেক দিন আগে ঘটা কিছু অদ্ভুত ঘটনার ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। সে সময় আমি স্রেফ একটা বাচ্চা ছিলাম, যে কিনা কিন্ডারগার্টেনে পড়ত। আমি প্রায়ই নার্ভাস থাকতাম আর সহজেই যে কোন কিছুতে আপসেট হয়ে যেতাম। সবাই আমার চেয়ে লম্বা ছিল, তাদের সাথে কথা বলতে আমাকে উপরে তাকাতে হত। যখনই বড়দের কেউ তাদের কোমরের উপর হাত রেখে রাগী রাগী চেহারা করে তাকাত, তখন আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতাম যে নিশ্চয়ই কোন ভুল করে ফেলেছি। তাই আমি যদি আমার বক্তব্য বড় কাউকে বুঝিয়ে বলতে যেতাম, জানতাম যে ঠিক মত বোঝানো যাবে না।
অনেক দিন আগে আমার ধারণা ছিল যে কিছু একটা আমার বিছানার নিচে বসবাস করে, যেখানে কোন আলো পৌঁছায় না। আমার ধারণা ছিল স্পর্শ না করে শুধু কঠিনভাবে চিন্তা করেই আমি একটা পেন্সিল গড়িয়ে ফেলতে পারব। শেষ পর্যন্ত এর সব কিছুই মিথ্যা প্রমানিত হয়েছিল, কিন্তু ওগুলোকে অসম্ভব কিছু মনে হয় নি, আপনি যদি বুঝে থাকেন আমি কি বলতে চাইছি। আমি সবসময়ই বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে এসেছি, কিন্তু তারপরেও আমার ধারণা এই জগতে কিছু বিষয় আছে যা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে না।
***
কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় আমার সাথে যে ঘটনাটা ঘটেছিল সেটা বলা যাক। আমার মনে হয়েছিল আমার নিজের স্মৃতি নিশ্চয়ই অনেকখানি মলিন হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে আমি প্রতিটা খুঁটিনাটি একটার পর একটা মনে করতে পেরেছিলাম, আর অন্যদের থেকেও এই সম্পর্কে জেনে নিয়েছিলাম। এসবকিছু একসাথে করে আমি এখন এটা বেশ ভালভাবে মনে করতে পারি।
আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে থাকতাম। শুধু আমরা তিনজন। একটা বিশাল বিল্ডিঙের দোতলার একটা অ্যাপার্টমেন্টে আমরা ভাড়া থাকতাম। ছোট একটা পাহাড়ের উপর ছিল বিল্ডিংটা। আমাদের জানালা থেকে আমরা নিচের শহর থেকে আসা আলো দেখতে পেতাম। ট্রেনের রেল লাইন আমাদের এলাকার এক মাথা থেকে পাশের এলাকার দিকে চলে গিয়েছিল, আশেপাশের বাড়িগুলোকে একসাথে সেলাইয়ের মত জোড়া দিয়ে। এই ছিল আমাদের বাসা থেকে দৃশ্য আর আমার এসব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেও ভাল লাগত।
আমাদের একটা লিভিং রুম, একটা কিচেন ছিল। সাথে সম্ভবত আরো দুটো রুম। আমার মনে পড়ে যে মূল দরজার কাছে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত একটা খাম্বা ছিল। ওখানে আমি আমার আঁকা বাবার ছবিগুলো লাগিয়ে রাখতাম। আমার স্কুলের ক্যাপ আর ব্যাকপ্যাকও ওখানে ঝুলিয়ে রাখতাম।
আমি আমার বাবা-মাকে ভালবাসতাম। শুধুমাত্র যে কার্ড গেমটা আমি খেলতে পারতাম তখন, সেটা ছিল “ওল্ড মারমেইড।” সবসময় আমরা সেটা খেলতে পছন্দ করতাম। আমরা বাসার মধ্যে লুকোচুরিও খেলতাম। কিচেনের টেবিলে বসে ডিনার খেতাম, তারপর লিভিং রুমে গিয়ে সোফায় বসে গল্প করতাম।
সোফাটা ছিল ধূসর রঙের। আমার মনে হয় আমাদের সমস্ত আসবাবপত্রের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল এই সোফাটাই। আমরা ওখানে বসে টিভি দেখতাম, নাহলে বই পড়তাম, কিংবা ছোট খাট ঘুম দিতাম। সত্যি বলতে কি আমাদের এই নরম কিন্তু দৃঢ় সোফাটাই ছিল আমাদের সুখি পরিবারের রহস্য। সোফাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেমনটা ছিল কফি টেবিল আর টিভিটাও।
টিভি দেখার সময় আমি সবসময় আমার বাবা-মায়ের মাঝখানে বসতাম।
মায়ের জায়গা ছিল আমার বামে, যেখান থেকে কিচেন কাছে ছিল। ফলে তার জন্য সহজ হত স্লিপার পরে কিচেনে গিয়ে বাবা আর আমার জন্য ড্রিঙ্ক নিয়ে আসতে। আমি জুস খেতাম আর বাবা বিয়ার।
বাবা আমার ডানে বসতেন। টিভি দেখার জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল ওটা। তাছাড়া এসিরও সবচেয়ে কাছে ছিল। আমার বাবা, যিনি সবসময় বলতেন যে তার বিচ্ছিরি রকমের গরম লাগে, ওখানে বসে ঠাণ্ডা হতেন। আমি সোফার মাঝখানে পা ঝুলিয়ে বসে তাদেরকে বলতাম স্কুলে কি কি হয়েছে। বাবা-মা আমার দুপাশে বসে হাসিমুখে আমার গল্প শুনতেন।