“তারমানে আপনি অনিশ্চয়তায় ভুগছেন ইনজেকশনটি কিনবেন কি কিনবেন না?” হাইজ্যাকার প্রশ্ন করল। আমি মাথা ঝাঁকালাম। সেলসম্যান কয়েকবার গলা খাঁকারি দিয়ে পরিস্কার করে হাইজ্যাকারকে বলল, “আপনার কি মনে হয়? আপনি এই কাজে কতখানি অবিচল? আমি বলতে চাইছি আত্মহত্যা করা ঠিক আছে কিন্তু আপনি আমাদের সবাইকে এর মধ্যে টানছেন কেন?”
অল্পবয়সি ছেলেটা শান্ত অভিব্যক্তি নিয়ে সেলসম্যানের দিকে ঘুরল। সেলসম্যান ওর চোখের দিকে তাকিয়ে একটু পিছিয়ে গেল।
“কারন সবকিছু সহ্যর সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে বলল।
***
“আমার মায়ের সবসময়ের বিশ্বাস ছিল টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাড়া আমার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। অন্য কোন সম্ভাবনা তার চিন্তার বাইরে ছিল। মা বলতেন, কেউ যদি টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারে তাহলে সে মানুষের জাত না, গরু-ছাগল বা সে-ধরনের কিছু। টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারা ছিল আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্য যা বলেন।”
“পাশ করার পর কি করতেন?” সেলসম্যান জিজ্ঞেস করল।
“ওই প্রশ্ন কখনো আমার মাথায়ই আসেনি। আমার একমাত্র চিন্তা ছিল শালার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে ভর্তি হওয়া যায়। আর কোন কিছুতেই কিছু আসে যায় না আমার। যে কারনে আমি রাতের বেলা বাসায় থেকে খালি পড়াশুনা করতাম। সবাই যখন মেয়েদের সাথে ডেট করছে কিংবা গেমস খেলছে, আমি তখন শুধুই পড়াশুনায় ব্যস্ত থেকেছি।”
“আর যখন পড়াশুনা করতেন না তখন কি করতেন?” আমি জানতে চাইলাম।
“তখন আমি আচার বানাতাম।”
সেলসম্যান আর আমার মধ্যে চোখাচোখি হল।
“আমার শখ হল জাপানি আচার বানানো,” সে বলল। “এর মধ্যে এত কাজ আছে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না, তারপর সে বলতে থাকল কিভাবে সঠিকভাবে সবজি কাটতে হবে, কিরকম কচকচে হতে হবে, কোন সময়ে কিরকম আচার হয়, কতটুকু লবণ দিতে হয় ইত্যাদি। কথাগুলো বলার সময় ওর বেশ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
“যখন বাসায় একা থাকতাম আর সবকিছু নিস্তব্ধ থাকত, তখন আচার বানানো আমাকে শান্তি দিত। প্রাইমারী স্কুলে থাকতে আমি আচার বানানো শুরু করি…”
সেলসম্যান নিচু গলায় আমাকে বলল, “মনে হচ্ছে এই ছেলে প্রাইমারি থেকেই আউলা কিসিমের। আপনার কি মনে হয়?”
“স্কুলের সবাই এই নিয়ে হাসত। ওরা বলত আমার পোশাকগুলো পুরনো আমলের। নতুন কিছু কিনতে আমার ভয় হত। মনে হত দোকানের লোকজন আমাকে দেখে হাসবে। আমার জন্য ফ্যাসনেবল হওয়া একটু
অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? মা আমার জন্য যা কিনে আনতেন আমি তাই পড়তাম। একমাত্র যা আমি নিজে কিনেছি তা হল নোটবুক আর লেখালেখির জিনিসপত্র। অন্য ছেলেমেয়েরা যখন তাদের জমানো টাকা দিয়ে সিডি কিনছে আমি তখন আমার হাত খরচের টাকা দিয়ে কিনেছি ফাউন্টেইন পেন। আমি সবসময় পড়াশুনা করতাম, যে কারনে স্কুলের কেউ আমার সাথে খেলতে চাইত না। তারা সবাই গোপনে গোপনে আমাকে ‘গন্ধমাদন ডাকত। অথচ আমি প্রতিদিনই গোসল করতাম।”
“একদম ভাল নাম না,” আমি বললাম, যদিও আমি টের পাচ্ছিলাম ছেলেটার শরীর থেকে হালকা আচারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
“আমার মা আর সব আত্মীয়স্বজনরা নিশ্চিত ছিল, আমি টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাব। কিন্তু পারিনি।”
“কেন?”
“তারা নেয় নি।”
“সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু কেন? প্রতিবছর পরীক্ষার সময় কি আপনি অসুস্থ থাকতেন বা কিছু?”
“না।”
“অন্য কাউকে সাহায্য করছিলেন যে নিজে সময় পাননি?” সেলসম্যান প্রশ্ন করল। “নাকি কোন ডুবতে থাকা বাচ্চাকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন? নাকি কোন ব্রেন টিউমারওয়ালা মৃত্যুপথযাত্রি বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে ছিলেন? অল্পবয়সি ছেলেটা দুঃখি মুখ নিয়ে খালি মাথা নেড়ে চলল।
“আমি নিজেও জানি না কেন। আমি আমার টিচারদের জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন আমি ভাল গ্রেড পাচ্ছিনা। তারা বলেছিলেন আমি নাকি টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মত যথেষ্ট ভাল নই। যত চেষ্টা করি না কেন গ্রেড উঠবে না। আমার উচিত হাল ছেড়ে দেয়া।”
ছেলেটা যথেষ্ট স্মার্ট ছিল না। প্লেনের কেউ কোন কথা বলল না কিন্তু সবার চেহারা দেখেই সেটা ভাবছে বোঝা যাচ্ছিল। ছেলেটা নিজেই বলল, “এটা অন্যায়, স্রেফ অন্যায়।” তারপর নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল।
“আমার মা, আমার আত্মীয়রা, সবাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। বুঝতে পারছেন আমার তখন কেমন লাগছিল? কিভাবে বোঝাব? সবাই যখন আমাকে প্রথমবার বলল যে আমি কখনো টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব না, তখন তাদের কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এই বছর, পর পর পাঁচ বার ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করার পর, বাধ্য হলাম মেনে নিতে যে আমাকে দিয়ে এই কাজ আর কখনো হবে না- তাহলে আমি কি করব? আমার মা আমাকে সবসময় শিখিয়ে এসেছেন, টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উপর আমার পুরো জীবন নির্ভর করছে। সবাই এখন আমাকে করুনার চোখে দেখে। যেখানেই যাই আমার মনে হয় সবাই আমাকে নিয়ে হাসছে।”
সে মাথা নিচু করে সিট থেকে সামনে ঝুঁকে থাকল। খালি হাতটা দিয়ে মুখ ঢাকা।
“কি জঘন্য ব্যাপার, সে গুঙিয়ে উঠল। কণ্ঠ নিচু আর হাত দিয়ে মুখ ঢাকা থাকায় চেহারা না দেখা গেলেও আমি ওকে বিড়বিড় করতে দেখতে পাচ্ছিলাম।
“আমি ওদের হাসি শুনতে পাই। আমার ক্লাসমেটদের কণ্ঠ শুনতে পাই। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে…আমার এন্টেনার মত দাঁড়িয়ে থাকা চুল নিয়ে…কোন মেয়ের হাত কখনো ধরিনি কেন সেটা নিয়ে…সবাই মনে মনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, আহ, পারছি না, আমাকে একা থাকতে দিন…একা থাকতে দিন…পারছি না আমি আর…সবাইকে খুন করে ফেলব, এই দুনিয়ার সবাইকে খুন করে ফেলতে চাই আমি…কিন্তু এটা অন্যায়…কেউ প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন…আমি আর এটা নিতে পারছি না। পালানোর কোন পথ খোলা নেই আমার সামনে…”