লোকটার চেহারা আমি পরিস্কার দেখতে পেলাম না। আমার চোখে তাকে অস্পষ্ট দেখাল, অনেকটা ছায়ার মত। একটা বিশাল কালো ছায়া, মৃত্যুর প্রতিনিধি হয়ে এসেছে।
ইলেকট্রিক করাত চালু হওয়ার শব্দ হল। পুরো রুম মনে হল সেই ভীষণ শব্দে ভয়াবহভাবে কাঁপতে লাগল।
রুমের কোনায় আমার বোন তার হাতগুলো সামনে ছড়িয়ে দিল। আক্রমণকারীর থেকে মুখ লুকাবে না সে।
“তুমি আমার ভাইয়ের উপর একটা আঙুলও তুলবে না!” সে চিৎকার করল। কিন্তু ইলেকট্রিক করাতের ভীষণ শব্দের নিচে ওর চিৎকার প্রায় ঢাকা পড়ে গেল।
আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে চিৎকার করতে চাইছিলাম। মৃত্যুর সময় কি রকম ব্যথা অনুভব হতে পারে তা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। ঘুরন্ত ব্লেডটা যখন আমাকে দুটুকরো করে ফেলবে তখন আমার কিরকম লাগতে পারে?
লোকটা আপর পেছনে লুকিয়ে থাকা আমার পোশাক দেখতে পেল। সে করাতটা তুলে আমাদের দিকে এগিয়ে এল।
“খবরদার! সামনে এগুবে না!” আপু চিৎকার করল। হাতগুলো বাঁধা দেয়ার ভঙ্গি করে রেখেছে। ওর গলা এবারও করাতের শব্দে ঢাকা পড়ে গেল কিন্তু আমি জানি ও তাই বলছিল। কারন যাই হোক আপু এক পা বাড়াল কথাগুলো বলার জন্য।
লোকটা আরেক পা ওর দিকে এগিয়ে ওর বাঁধা দেয়া হাতের উপর করাতের দুরন্ত ব্লেড নামিয়ে আনল। এক মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে বৃষ্টির মত রক্ত ছিটকে উঠল।
আমি এসবের কোন কিছুই পরিস্কার দেখতে পাইনি। লোকটার আকার, আর আপুর হাত আলাদা হয়ে যাওয়ার পুরো দৃশ্যটাই আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল। কারন আমি ঘোলাটে পানির ভেতর থেকে দৃশ্যটা দেখছিলাম।
টানেলের লুকানো জায়গা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আমি ভোলা দরজার দিকে দৌড় দিলাম। বের হয়েই আমি সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ছিটকিনি টেনে দিলাম।
বন্ধ দরজাটা ইলেকট্রিক করাতের শব্দ কমিয়ে দিল। আমার বোন আর খুনিটা এখন রুমের ভেতর একা।
***
আপু যখন আমার মাথায় হাত রাখল, তখন বুঝলাম আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। আমি তাড়াতাড়ি স্রোতের বিপরীত দিকের টানেলে ঢুকে পড়লাম। ওইদিক থেকে দরজা কাছে ছিল।
এই জুয়া খেলাটা আপুর পরিকল্পনা ছিল। সে রুমের কোনায় আমার কাপড় চোপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এমন ভাব করবে যেন আমাকে পেছনে রেখে খুনির থেকে রক্ষা করতে চাইছে। সেই সুযোগে আমি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব। এই ছিল প্ল্যান।
আমরা আমার পোশাক সেভাবে সাজিয়েছিলাম। অন্য রুমের মেয়েদের কাছ থেকে কাপড় এনে সেটাকে ফুলিয়ে মানুষের রূপ দিয়েছিলাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম না টোপটা কাজ করবে কিনা, কিন্তু আপু বলেছিল কয়েক সেকেন্ড হলেও সময় পাওয়া যাবে। আপু ভান করবে যে আমাকে রক্ষা করছে। আসলে সে আমার কাপড়গুলোকে রক্ষা করছিল।
ও দাঁড়িয়ে ছিল দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের কোনায়। খুনি তার দিকে এগুলো এমনভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল যেন লোকটা আমাকে টানেল থেকে বের হতে না দেখতে পায়।
লোকটা যখন আপুর কাছে গিয়ে করাত দিয়ে হাতে আঘাত করল আমি সেই মুহূর্তে টানেল থেকে বের হয়ে খোলা দরজা দিয়ে..
দরজায় ছিটকিনি লাগানোর পর আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। আমি আমার বোনকে ফেলে রেখে এসেছি খুন হওয়ার জন্য। একা শুধু নিজে পালাতে পেরেছি। আমাকে পালানোর সুযোগটা দেয়ার জন্য আপু নিজে করাত থেকে পালানোর চেষ্টা করেনি। রুমের কোণায় দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করেছে।
দরজার ওপাশ থেকে করাতের শব্দ থেমে গেল।
কেউ একজন দরজায় কিল দিচ্ছিল। যেহেতু আপুর হাত নেই, আমি নিশ্চিত খুনি লোকটাই হবে।
অবশ্যই দরজা বন্ধ থাকল।
ভেতর থেকে আপুর হাসির শব্দ ভেসে এল। প্রাণ খোলা হাসি, যেন বিজয়ের আনন্দ ঘোষণা করছে। ও নিশ্চয়ই আনন্দিত জেনে যে তার ছোট প্ল্যানটা কাজ করেছে।
আমি জানি আপুকে লোকটা হয়ত টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ক্ষেপে গিয়ে হয়ত আরো নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নেবে। তারপরেও আপু খুনিকে বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দিয়ে আমাকে বাঁচার একটা সুযোগ করে দিতে পেরেছে।
ডানে বামে তাকালাম। কোন জানালা নেই, একটা লম্বা হলওয়ে দেখে নিশ্চিত হলাম, আমরা মটির নিচে কোন জায়গায় আছি। আমার সামনে সাতটা দরজা দাঁড়িয়ে আছে।
চার নাম্বার রুম ছাড়া বাকি সব রুমের দরজার ছিটকিনি খুলে দিলাম। জানতাম তিন নাম্বার রুমে কেউ নেই তারপরেও দরজাটা খুলে রাখলাম। অনেক মানুষ ওই রুমে খুন হয়েছে, সেজন্য মনে হল দরজাটা খুলে রাখা উচিত।
রুমগুলো থেকে বের হওয়া মেয়েরা আমার চেহারা দেখে কিছু বলল, শুধু নড করল। তাদের কেউই সত্যি সত্যি আনন্দিত নয়। আমি ওদেরকে আপুর প্ল্যান সম্পর্কে জানিয়েছিলাম। ওদের জানিয়েছিলাম যে আমি যখন পালাব আপু তখন রুমে একা আটকা পড়ে খুন হবে। আমরা সবাই এটা জানতাম।
পাঁচ নাম্বার রুমের মেয়েটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। তারপর আমরা সবাই একটা দরজার সামনে জড় হলাম।
ভেতর থেকে তখনো আপুর হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।
আবারো ইলেকট্রিক করাত চালুর শব্দ শুরু হল। আমরা বুঝতে পারছিলাম লোকটা ইলেকট্রিক করাত দিয়ে লোহার দরজাটা কাটার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা সবাই নিশ্চিত ছিলাম যে দরজাটা যথেষ্ট মজবুত, লোকটা কোনদিনও এই রুম থেকে বের হতে পারবে না।