আপু আমাকে বলল আরেকবার নালা দিয়ে গিয়ে সবার সাথে কথা বলতে।
সময় খুব বেশি বাকি নেই।
এই নালা দিয়ে কতজন মানুষের লাশ ভেসে গিয়েছে এখন পর্যন্ত? আমি নোংরা পানিতে নেমে সাঁতরে চারকোনা গর্ত দিয়ে অন্য রুমগুলোতে গেলাম।
আমি আর আপু ছাড়া আরো পাঁচজন মেয়েকে লোকটা বন্দি করে রেখেছে। ওদের মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের পরের তিন রুমের বন্দিরা নালা দিয়ে রক্ত মাংস ভেসে যেতে দেখেছে।
আমি ওদের রুমে গেলাম, ওদের সাথে কথা বললাম। ওরা সবাই জানে আজকে আমার আর আপুর শেষ দিন। তারা সবাই আমাদের জন্য কষ্ট পাচ্ছিল। একজন আমাকে বলল আমার উচিত অন্য রুমে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করা।
“এটা নাও,” পাঁচ নাম্বার রুমের মেয়েটা আমাকে ওর সাদা সোয়েটারটা দিল। এখানে গরম। আমার এটার কোন দরকার নেই।”
তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরল।
“তোমার আর তোমার বোনের ভাল হোক সেই প্রার্থনা করি,” সে। বলল। ওর গলা কাঁপছিল।
ছয়টা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই।
***
আপু আর আমি রুমের কোণায় বসেছিলাম। দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের কোনায়।
আমি একদম কোনায় বসেছিলাম। আপু বসেছিল আমার পাশে। দেয়ালের দিকে চেপে রেখেছিল। আমরা আমাদের পা ছড়িয়ে বসেছিলাম। ওর হাত আমার হাতে ঘষা খাচ্ছিল। আমি ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলাম।
“আমরা যদি এখান থেকে পালাতে পারি, প্রথম কাজ কি করতে চাস তুই?” আপু জানতে চাইল। “যদি আমরা এখান থেকে বের হতে পারি…” এই প্রশ্নটার অনেকগুলো উত্তর আমার কাছে।
“জানি না,” আমি বললাম, কিন্তু আসলে আমি আন্ধু-আম্মুকে দেখতে চাই। আমি বাইরের পরিস্কার বাতাসে গভীরভাবে নিশ্বাস নিতে চাই। চকলেট খেতে চাই। আমি করতে চাই এরকম জিনিসের সংখ্যা অসংখ্য। যদি আমার আশা পূরণ হয়, আমি হয়ত কেঁদে ফেলব। আমি যখন এসব আপুকে বললাম, সে এমন একটা চেহারা করল যার অর্থ হয়, “জানি তো।”
আমি মুহূর্তের জন্য ওর হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। আপু সিলিঙের ইলেকট্রিক বাটার দিকে তাকাল। আমিও তাকালাম ওটার দিকে।
এই রুমে বন্দি হওয়ার আগে পর্যন্ত আপু আর আমি নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি ছাড়া আর কিছুই করিনি। মাঝে মাঝে আমার এমনও মনে হয়েছে কেন আমার একটা বোন থাকতে হল। প্রতিদিন আমরা একজন আরেকজনকে যেভাবে পেরেছি অপমান করার চেষ্টা করেছি। আমাদের কারো কাছে চকলেট থাকলে আরেকজন সেটা চুরি করার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু এগুলো সবই এখন অতীত। ও এখন আমার পাশে আছে এই ব্যাপারটাই আমাকে অনেক সাহস দিচ্ছিল। ওর শরীরের উষ্ণতা প্রমাণ করে দিচ্ছিল যে এই দুনিয়ায় আমি একা নই।
অন্য রুমের মেয়েদের থেকে আপু অনেকটা আলাদা। আগে কখনো এভাবে চিন্তা করিনি, কিন্তু আপু আমাকে একদম বাচ্চাকাল থেকে চেনে। এই ব্যাপারটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
“আমার যখন জন্ম হল, তখন তুমি কি ভেবেছিলে?” আমি যখন প্রশ্নটা করলাম তখন ও আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাল। ও হয়ত ভাবছিল এই মুহূর্তের জন্য প্রশ্নটা খুবই অস্বাভাবিক ধরনের কিছু।
“এই জিনিসটা আবার কি? আমি এই কথাটা ভেবেছিলাম। প্রথমবার তোকে যখন দেখি তুই বিছানায় শুয়ে ছিলি। খুবই ছোট, কান্নাকাটি করছিলি। সত্যি বলছি আমার মনে হয়নি তোর সাথে আমার কোন মিল আছে।” আপু বলল।
তারপর আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। ব্যাপারটা এমন যেন আমাদের একে অপরকে বলার মত কিছু ছিল না। স্লান একটা ইলেকট্রিক বা কংক্রিটের একটা বাক্সের মধ্যে হালকা আলো ছড়াচ্ছিল, নালা দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছিল, আর আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার ভেতরে, অনেক গভীরে কোথাও যেন আমি আর আপু অনবরত কথা বলে যাচ্ছিলাম। মৃত্যু নামের বস্তুটা আমাদের উপর এসে নিশ্বাস ফেলছিল, কিন্তু আমাদের আত্মাগুলো একদম শান্ত হয়ে ছিল।
আমি ঘড়ি দেখলাম।
“তুই রেডি?” আপু জিজ্ঞেস করল। জোরে দম নিচ্ছে। আমি মাথা ঝাঁকালাম। টেনশন হচ্ছে। যে কোন সময় শুরু হবে। কান সতর্ক রাখলাম, পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ পাওয়া যায় কিনা শোনার জন্য।
এভাবে কয়েক মিনিট যাওয়ার পর মদু পায়ের শব্দ আমার কানে এল। আমি আপুর হাতে হাত রাখলাম। সময় হয়ে গিয়েছে।
আপু উঠে দাঁড়াল, আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
পায়ের শব্দ আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগল।
আপু আলতো করে আমার মাথায় হাত রাখল। নীরবে সংকেত দিল যে আলাদা হওয়ার সময় হয়েছে।
আপু আর আমি সিদ্ধান্তে এসেছি, আমরা যদি ইলেকট্রিক করাত ওয়ালা লোকটার সাথে লড়াই করি তাহলে শেষ পর্যন্ত জেতার কোন সম্ভাবনা আমাদের নেই। আমরা সেফ শিশু। আর লোকটা একজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ। ব্যাপারটা দুঃখজনক কিন্তু সত্য।
দরজার নিচের ফাঁকে একটা ছায়া দেখা গেল।
আমার বুক মনে হচ্ছিল যে কোন সময় ফেটে যাবে। শরীরের ভেতরের সবকিছু গলা দিয়ে উঠে আসতে চাইছিল। এখানে আটকা পড়া দিনগুলো সব একসাথে মনে পড়ল, সেই সাথে ফিরে এল খুন হওয়া মানুষগুলোর চেহারা আর কণ্ঠস্বর।
দরজা থেকে দূরে থাকার পরেও ছিটকিনি খোলার আওয়াজ কানে এল।
আপু পিছিয়ে রুমের সবচেয়ে দূরের কোনায় সরে গেল আর অপেক্ষা করতে লাগল। আমার দিকে তাকাল। মৃত্যু এসে হাজির হয়েছে।
ভারি লোহার দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। দরজার বাইরে একজন লোককে দেখা গেল। সে রুমের ভেতর ঢুকল।