কংক্রিটের জেলখানায় বন্দি মহিলার পাশে গিয়ে বসলাম।
“তুমি কি দেখেছ?” সে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
আমার চেহারা দেখে নিশ্চয়ই কিছু বোঝা যাচ্ছিল। এই মেয়েটাকে গতকাল মাত্র এখানে আনা হয়েছে। বন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে নতুন। আমি তাকে এরই মধ্যে সাত রুমের নিয়ম জানিয়েছি। কিন্তু তারপরেও মাত্র কি দেখে এসেছি তা বলার মত অবস্থা আমার ছিল না।
আমি তিন নাম্বার রুমের মেয়েটার দেয়া নোটবকটা খুললাম। পানিতে ভিজে নোটবকটার পাতাগুলো একসাথে জোড়া লেগে গিয়েছিল। সেগুলো ছাড়াতে খানিকটা কষ্ট করতে হল। পাতায় ভাঁজ পড়লেও লেখাগুলো পড়া যাচ্ছিল।
ওর বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বিশাল একটা চিঠি লেখা ছিল। “আমাকে ক্ষমা করে দিও,” কথাটা বারবার লেখা ছিল।
ষষ্ঠ দিন : বৃহস্পতিবার
লোকটাকে দেখে আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে চার নাম্বার রুমে ফিরে যেতে পারছিলাম না। এক নাম্বার রুমে আমি সারারাত কাটালাম। মেয়েটা আমার সঙ্গ পেয়ে এতটা খুশি হয়েছিল যে ওর নাস্তার রুটির বেশিরভাগই আমাকে দিয়ে দিল। খেতে খেতে আমার মনে হল আপু নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করছে।
ধীরে ধীরে আমি আমাদের রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারলাম। আমি টানেলের মধ্যে দিয়ে দুই নাম্বার রুমে গেলাম। ওই রুমে একজন নতুন বন্দি এসেছে। বাকি সবার মতই সেও আমাকে নালা থেকে উঠতে দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগল।
তিন নাম্বার রুম খালি ছিল। রক্ত মাংস সব ধুয়ে পরিস্কার করে ফেলা হয়েছে। যে মানুষটা আগেরদিন আমার সাথে বসে গল্প করছিল তার উপস্থিতির সামান্য লক্ষণও পাওয়া যায় কিনা আমি সেখানে খুঁজলাম। কিন্তু কিছু ছিল না। স্রেফ একটা খালি কংক্রিটের রুম।
আমাদের রুমে ফিরতেই আপু আমাকে জড়িয়ে ধরল।
“আমি ভেবেছি সে তোকে ধরে ফেলেছে আর খুন করে ফেলেছে!”
তারপরেও ও পাউরুটিটা খায়নি, আমার আসার জন্য অপেক্ষা করছিল।
আজকে, বৃহস্পতিবার, আমাদের বন্দিত্বর ষষ্ঠ দিন। আজকে আমার বোন আর আমার খুন হওয়ার কথা।
আমি ওকে বললাম যে আমি এক নাম্বার রুমে ছিলাম আর ওই মেয়েটার খাবার ভাগ করে খেয়েছি। ওকে বললাম যে ও পুরো রুটিটা খেতে পারে, আমি যেহেতু খেয়ে এসেছি। কান্নাকাটি করার কারনে আপুর। চোখগুলো লাল হয়ে ছিল। ও আমাকে অনেক বকাঝকা করল।
আমি ওকে তিন নাম্বার রুমের মেয়েটার কথা বললাম। বললাম কিভাবে মেয়েটাকে খুন করা হয়েছে, কিভাবে আমি নালায় লুকিয়ে তা দেখেছি, অনেক চেষ্টা করেও খুনির চেহারা দেখতে পারিনি।
“কেন তুই এরকম বিপদজনক কিছু করতে গেলি?” ও ক্ষেপে উঠল আমার উপর। আমি ওকে দরজাটার কথা বললাম। শুনতে শুনতে ও ঠান্ডা হয়ে এল।
ও উঠে গিয়ে লোহার দরজাটার উপর হাত বুলাল। মুঠি দিয়ে কিল মেরেও দেখল। ধাতুর উপর ওর নরম হাতের বাড়ি প্রতিধ্বনি তুলে পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়ল।
“সত্যি?” ও অবশেষে বলল। “দরজার ওপাশে একটা ছিটকিনি আছে?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম। দরজার ভেতর ডান দিক থেকে ছিটকিনির কজার চিহ্ন আছে। দরজাটা রুমের মধ্যে পুরো ভোলা ছিল। টানেলের ভেতর থেকে আমি দরজার বাইরের অংশ পরিস্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। ছিটকিনিটা পুরাতন ধরনের, ভারি। আনুভূমিকভাবে লাগানো যায়। আমি আমাদের রুমের দরজাটার দিকে তাকালাম। ওটা দেয়ালের ঠিক মাঝখানে নয়, একটু বাম দিকে লাগানো।
আপুও ভয়ার্ত চোখে দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকল।
ওর হাতঘড়ি অনুযায়ী এখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। আর মাত্র ছয় ঘন্টা পর খুনি এসে আমাদের জবাই করবে।
আমি রুমের এক কোনায় বসে নোটবুকটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওই মেয়েটা ওর বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লিখেছিল। আমি আমার বাবা-মায়ের কথা ভাবতে লাগলাম। আমি নিশ্চিত তারা সবাই আমাদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। যেসব রাতে আমার ঘুম হয় না, আম্মু মাইক্রোওয়েভে গরম করে আমার জন্য দুধ নিয়ে আসত। আগেরদিন নোংরা পানিতে চোখ খুলে তাকানোর জন্য হয়ত, চোখগুলো অনেক জ্বলছিল। সহজেই অণু বেরিয়ে এল।
“আমি এভাবে সব শেষ হতে দিতে পারি না…কিছুতেই না!” আপু ফোঁপাচ্ছিল, ওর গলার স্বরে ক্রোধ টের পাচ্ছিলাম। ওর হাতগুলো ভীষণভাবে কাঁপছিল। ও যখন আমার দিকে ফিরল তখন ওর চেহারা যেন জ্বলছিল। ওর চোখের সাদা অংশগুলো থেকে যেন আলো ঠিকরে বের হচ্ছিল।
আগেরদিন দেখা অসহায় চোখগুলোর মত নয় ওগুলো। ওর চেহারায় মনে হচ্ছিল কোন ভয়ংকর, বিশাল কোন সিদ্ধান্ত লিখে রাখা হয়েছে।
আপু আবার আমাকে খুনি লোকটার শারীরিক গঠন আর ইলেকট্রিক করাত নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করল। আমি বুঝতে পারলাম, খনি যখন আমাদের জন্য আসবে তখন তার সাথে লড়াই করার চিন্তা করছে আপ।
খুনির ইলেকট্রিক করাতটা লম্বায় আমার অর্ধেক উচ্চতার হবে। আর ওটা যেভাবে শব্দ করছিল, মনে হচ্ছিল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। এরকম একটা অস্ত্রওয়ালা মানুষের বিরুদ্ধে আপু কিভাবে লড়াই করবে? কিন্তু আমাদের সামনে আর কোন উপায় তো নেই। আমরা যদি লড়াই না করি তাহলে সেফ মারা পড়ব।
আপু ওর ঘড়ি দেখল।
যখন সময় হবে, লোকটা ফিরে আসবে। ফিরে এসে আমাদের খুন করবে। আমরা এখন যেই দুনিয়ায় আছি তার নিয়ম এটা। এর ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই। মৃত্যু আমাদের নিশ্চিত।