যে লোকটা আমদের আটকে রেখেছে সে হাজির হয়েছে। আমি ইতিমধ্যে ধরে নিয়েছি লোকটার চেহারা একটা নিষিদ্ধ বিষয়। মরার আগে এই চেহারা কোনভাবে দেখা যাবে না। মৃত্যু দেবতার এরকম একটা ছবি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।
হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।
আমি টানেল দিয়ে ঢুকে দুই নাম্বার রুমে হাজির হলাম। যেমনটা ভেবেছিলাম, রুমটা খালি। আমি নালায় দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। আমাকে দেয়া নোটকটা মেঝের উপর রাখলাম।
এই মুহূর্তে যে লোকটা আমাদের রুমগুলোতে আটকে রেখেছে সে তিন নাম্বার রুমের মেয়েটাকে খুন করছে। হঠাৎ একটা চিন্তা আমাকে গ্রাস করল। আমার পুরো শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল। আমি যা চিন্তা করছিলাম তা অত্যন্ত বিপদজনক। কিন্তু আমাকে সেটা করতে হবে।
আমার বোন আর আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে। আমি মগজ চষে ফেলছিলাম কিভাবে সেটা করব। আবার আকাশ দেখতে চাইলে আমাকে এখনই কোন উপায় খুঁজে বের করতে হবে যাতে এখান থেকে বের হতে পারি।
আর সেটা করতে হলে আমাকে এই অন্ধকার ধাঁধার মধ্যে কিছু একটা দেখতে হবে, আর আপুকে জানাতে হবে কি দেখেছি। যে লোকটা আমাদের এখানে আটকে রেখেছে তাকে আমার দেখতে হবে। আমাকে জানতে হবে কিভাবে সে আমাদের খুন করতে যাচ্ছে। তার কাজ করার ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
তিন নাম্বার রুমে ফিরে যাওয়ার আগে প্রথমে নিজেকে শান্ত করলাম। ধরা পরে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে আমাকে চোখের পলক ফেলার আগেই হয়ত খুন করা হবে। আমার পরিকল্পনা হল নালার ভেতর বসে থেকে যতটুকু সম্ভব পর্যবেক্ষণ করা। এতটাই টেনশন হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরছিল। যদি লোকটা আমাকে দেখে ফেলে তাহলে হয়ত আমাকে খুন করার জন্য আর একটা দিন অপেক্ষা করতে যাবে না।
দুই নাম্বার রুমের দেয়ালের নিচে চারকোনা সরু গর্তটা দিয়ে তিন নাম্বার রুমে ঢুকতে হবে। আমি যেদিক থেকে মাত্র বের হলাম সেদিকে হাঁটু গেড়ে বসলাম। পানির স্রোত আমার পায়ের পেছন দিকে ধাক্কা দিলে চারকোনা গর্তটা আমাকে আস্তে করে নিজের দিকে টেনে নিল।
জোরে দম নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম, খেয়াল রাখলাম যেন কোন শব্দ হয়। পানির সোত হালকাই ছিল। যতক্ষণ আমি সতর্ক থাকছি ততক্ষন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। হাত-পা ব্যবহার করলে স্রোতের বিপরীতেও যেতে পারব। আগে বারবার যাওয়া আসার ফলে জানি। কংক্রিটের দেয়ালটা পিচ্ছিল, শ্যাওলা মাখা। আমাকে সাবধান হতে হবে।
চারকোনা টানেলের ভেতর পানির তল আর সিলিঙের মধ্যে খালি জায়গা খুবই কম। তিন নাম্বার রুমে কি হচ্ছে দেখতে চাইলে আমাকে। টানেল থেকে উঁকি দিয়ে পানির নিচ থেকে চোখ খুলে দেখতে হবে।
নোংরা পানি চোখে ঢুকবে এই চিন্তা মাথায় এলেও আমি চোখ খুললাম।
হাত আর পা দিয়ে রুমে ঢোকা থেকে নিজেকে থামালাম। পানি আমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। কিছু বুদবুদ ছাড়লেও হালকা আলো আমার চোখে পড়ল।
পানির স্রোতের ভেতর দিয়ে একটা মেশিনের শব্দ পাচ্ছিলাম।
পানি ঘোলাটে হওয়ায় ভাল মত দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে একজন লোকের নড়াচড়া চোখে পড়ছিল।
পোকামাকড়সহ এক গাদা পঁচা কিছু, আমার গালের পাশ দিয়ে ভেসে গেল।
ভাল করে দেখার জন্য আমি টানেলের আরেকটু কাছে গেলাম।
হাত ছুটে গেল। আঙুল পিছলে যাওয়ায় নালার দেয়ালের শ্যাওলায় খামচির মত দাগ পড়ল। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে আটকালাম। কপাল ভাল আমার শরীর থামল। তবে টানেল থেকে মাথা বেরিয়ে ঝুলছিল।
আমি তাকালাম।
যে মেয়েটার সাথে আমি একটু আগেও কথা বলছিলাম সে এখন এক দলা মাংস আর রক্তে পরিণত হয়েছে।
যে লোহার দরজা আমি এখন পর্যন্ত সবসময় বন্ধ দেখে এসেছি, সেটা হাঁ করে খোলা। দরজা ভেতরের দিকে খোলা থাকায় বাইরে লাগানো ছিটকিনি চোখে পড়ল। এই ছিটকিনি দিয়েই আমাদেরকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত।
আর দেখলাম…একজন লোক। লোকটা লাল একগাদা বস্তুর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল যেটাকে আর কোনভাবেই মৃতদেহ বলা যাবে না। সে আমার দিকে পেছন ফিরে ছিল। আমার দিকে মুখ করা থাকলে অবশ্যই এতক্ষণে আমাকে দেখে ফেলত।
আমি তার চেহারা দেখতে পারিনি কিন্তু লোকটার হাতে ধরা ইলেকট্রিক করাতটা ভয় ধরানোর মত শব্দ করছিল। আমি উপলদ্ধি করলাম এই শব্দটাই আমরা আমাদের রুম থেকে শুনতে পেতাম। লোকটা সোজা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, অনুভূতিবিহীন, সামনে রাখা বস্তুর দলার উপর নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। টুকরোগুলোকে আরো ছোট ছোট টুকরোতে পরিণত করছিল। মাংসের ছোট ছোট টুকরো বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়ছিল। পুরো রুমটা লাল রঙ ধারন করেছিল।
হঠাৎ করাতের শব্দ থেমে গেল। আমার আর লোকটার মধ্যে শুধুমাত্র পানির স্রোতের শব্দ ছাড়া আর কিছু ছিল না।
এমন সময় সে ঘুরতে শুরু করল।
আমি নখ দিয়ে টানেলের পেছন দেয়াল খামচে দ্রুত নিজেকে টানেলে ফিরিয়ে নিলাম। মনে হয় না লোকটা আমাকে দেখেছে, তবে আমি যদি আর এক মুহূর্ত দেরি করতাম তাহলে আমাদের মধ্যে চোখাচোখি হত।
তারপর দুই নাম্বার রুমে ফিরে গেলাম যেখানে কেউ ছিল না। যদিও নিজেকে আমার একদমই নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। নতুন কাউকে এখানে এনে রাখা হবে আর আমার জানার কোন সুযোগ নেই কখন দরজাটা খলবে। আমি নোটবকটা তুলে নিয়ে এক নাম্বার রুমের দিকে এগুলাম। তিন নাম্বার রুম পার হয়ে চার নাম্বারে, যেখানে আপু রয়েছে, সেখানে যাওয়ার আপাতত কোন উপায় নেই।