“কিন্তু তুই…তুই এক রুম থেকে আরেক রুমে যেতে পারিস। খুনি হয়তো কখনো তোকে ধরতে পারবে না,” আপু আমাকে বলল। আমি আবার নালার টানেলে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। “যে লোকটা আমাদের এখানে আটকে রেখেছে সে জানে না যে তুই এটা পারিস। কাল যদি এই রুমে আমি খুন হইও, তুই অন্য রুমে পালিয়ে যেতে পারবি। যতদিন তুই রুম থেকে রুমে পালিয়ে বেড়াতে পারবি ততদিন বেঁচে থাকবি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু এক সময় আমার শরীর বাড়বেই, তখন আর নালী দিয়ে যেতে পারব না। তাছাড়া খুনির নিশ্চয়ই মনে আছে যে এই রুমে সে দুজনকে বন্দি করে রেখেছিল। আমাকে যদি এখানে খুঁজে না পায় তাহলে সে অন্য জায়গায় আমাকে খুঁজবে।”
“তারপরেও,” আপু মরিয়া হয়ে বলল, “তুই আরো কিছুদিন তো বেঁচে থাকতে পারবি।” আমি ভাবলাম এই পরিস্থিতি আমাকে খুব কমই বাঁচার সুযোগ দেবে। কিন্তু আপু মনে করছে এটা আমার জন্য পালানোর একটা সুযোগ।
আমি নিশ্চিত ছিলাম, এখানে সুযোগ বলতে আসলে কিছু নেই। এখান থেকে জীবিত বের হওয়ার রাস্তা সব বন্ধ।
***
তিন নাম্বার রুমের মেয়েটা, যে কিনা একটু পর খুন হবে, আমার সাথে গল্প করছিল। ওর নামটা একটু অন্যরকম ছিল। প্রথম যখন সে তার নাম বলল আমি বুঝতে পারছিলাম না সেটার বানান কি হবে। ও পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করে বাল্বের ম্লান আলোতে আমাকে লিখে দেখিয়েছিল। নোটবুকের সাথে একটা ছোট পেন্সিল লাগানো ছিল। পেন্সিলটার লেজের দিকে দাঁত দিয়ে অসংখ্যবার কামড়ানোর চিহ্ন। শীষটাও ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিল শীষটা ক্ষয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা ঘষে ঘষে কাঠ উঠিয়ে বাকিটা বের করেছে।
“জানো, আমি শহরে থাকি বলে বাবা-মা সবসময় আমাকে খাবার পাঠাতেন। আমি একমাত্র সন্তান হওয়াতে তারা আমাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করতেন। কার্ডবোর্ডের বাক্স ভর্তি করে আমাকে আলু আর শসা পাঠাতেন। ডেলিভারিম্যান সেগুলো আমার কাছে নিয়ে আসত। আমি কাজে থাকতাম, বাসায় থাকতাম না বলে কখনো নিজে গিয়ে নিতে পারতাম না।”
তখনো সে এই ভেবে দুশ্চিন্তা করছিল যে ডেলিভারিম্যান ওর বাসার দরজার সামনে বাবা-মায়ের পাঠানো প্যাকেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিনা। ওর চোখ পড়ল নালার পোকামাকড় ভেসে যাওয়া পানির উপর।
“আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাড়ির কাছে ছোট একটা নদী ছিল। আমি সেখানে গিয়ে খেলতাম। নদীর পানি খুবই স্বচ্ছ ছিল। উপর থেকে তাকালে তুমি নিচের পাথরগুলো দেখতে পাবে।” ওর কথা শুনে আমার মনে হল আমি যেন নদীটাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। পুরো দৃশ্যটা স্বপ্নের মত। সূর্যের আলো এসে পানিতে পড়ছে। উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মাথার উপর বিশাল নীল আকাশ।
এই ছোট রুমগুলোতে আটকে থেকে আমি কেমন জানি একটু অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম। রুমগুলোর ধূসর কংক্রিটের দেয়াল আর নালা থেকে উঠে আসা পচা গন্ধ, আমি ভুলে যাচ্ছিলাম সাধারণ পৃথিবীর কথা যেখানে কিনা কিছুদিন আগেও বাস করতাম। বাইরের পৃথিবীর কথা চিন্তা করলে বিষণ্ণ লাগত, যেখানে বাতাস বইত আর বাতাসটাও কত্ত সতেজ ছিল।
আমি আবার আকাশ দেখতে চাই। জীবনে এত মরিয়াভাবে আর কিছু কখনো চাইনি। এখানে আসার আগে কখনো কেন মেঘ দেখার জন্য সময় ব্যয় করিনি?
মাত্র একদিন আগে আমি দুই নাম্বার রুমে মেয়েটার সাথে বসে একইরকম কথা বলছিলাম।
এই মেয়েটা তার প্রতি অন্যায়ের বিপক্ষে কোন কথা বলেনি, কোন অভিযোগ করেনি। সে শুধু বসে থেকে আমার সাথে কথা বলেছে। একদম স্বাভাবিকভাবে। যেন আমরা দুজন কোন এক বিকেলে পার্কের বেঞ্চে বসে গল্প করছিলাম। অল্প সময়ের জন্য হলেও মেয়েটা আমাকে এই নিষ্ঠুর ধূসর দেয়ালের ছোট রুমগুলোর কথা ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল।
আমরা দুজন একসাথে গানও গেয়েছিলাম। আমি এখনো বুঝতে পারছি না কেন আমার এই নতুন বন্ধুকে খুন হতে হবে। তারপর আমার মনে পড়ল আমি নিজেও তো খুন হতে যাচ্ছি এর পর।
আমার প্রশ্নগুলোর একটা যুক্তিযুক্ত উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালালাম। কিন্তু প্রতিবারই একই সমাপ্তিতে এসে পৌঁছলাম। আমি মরতে যাচ্ছি কারন যে লোক আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে সে আমাকে খুন করতে চায়।
নোটবুকটা আমার হাতে দিয়ে বলল মেয়েটা, “যদি তুমি এখান থেকে বের হতে পার, তাহলে এই নোটবুকটা আমার বাবা-মায়ের হাতে দেবে। প্লিজ।”
“কিন্তু…”
বের হতে পারলে? আমি কি কখনো সেটা আসলেই পারব? মাত্র আগেরদিনই দুই নাম্বার রুমের মেয়েটা আশা করছিল আমি এখান থেকে পালাতে পারব, আর ওর গলার চেইন আমার গলায় পড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের এরকম ভাবার আসলে কোন কারন নেই যে আমি এখান থেকে বের হতে পারব।
আমি মাত্র সেটা বলতে যাচ্ছিলাম এমন সময় টের পেলাম কেউ একজন দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
“ওহ না!” সে বলল, মখ শুকিয়ে গিয়েছে ওর।
ছয়টা বেজে গিয়েছে। আমার আরো আগে চলে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু সময়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মেয়েটার হাতে কোন ঘড়ি ছিল না, আর আমরা এত ভাল সময় কাটাচ্ছিলাম যে আমারও হুঁশ ছিল না।
“তাড়াতাড়ি পালাও এখান থেকে তাড়াতাড়ি!”
আমি লাফ দিয়ে উঠে নালায় ঝাঁপ দিলাম। সোতের বিপরীত দিকের চারকোনা গর্তটা কাছে হওয়ায় সেদিকে গেলাম। উল্টোদিকের গর্তটা দিয়ে আমাদের রুমে যেতে হবে। গর্তে ঢোকার সাথে সাথে ভারি লোহার দরজা খোলার শব্দ কানে এল। মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে হল মাথাটা যেন গরম হয়ে গেল।