“আপনারা সিটের পেছনে লুকিয়ে বসে কিছু একটা নিয়ে ফিসফিস করছিলেন। আমার মনে হয় আপনারা পরিকল্পনা করছিলেন কিভাবে আমার থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়া যায়। কিংবা আপনারা হয়ত আমার চেহারা, আমার পোশাক, আমার স্কুলের নাম নিয়ে বাজে কথা বলছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন। প্রথমে আমি তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে আমি উপলদ্ধি করলাম…কিভাবে বলা যায়…আপনারা দুজন অন্য যাত্রিদের থেকে অন্যরকম আচরণ করছিলেন।”
“তাই নাকি?” আমি বললাম, কুঁকে ভাল করে ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করলাম। হাইজ্যাকারকে দেখে মনে হল বিব্রতবোধ করছে। খালি হাতটা দিয়ে মাথার চুল শোয়ানোর চেষ্টা করছে সে। কিন্তু মাঝখানের এক ফালি চুল এন্টেনার মত সোজা হয়েই থাকল।
“অন্য সব যাত্রিরা ভয়ে রীতিমত জমে আছে। এমনকি যারা হিরো হওয়ার চেষ্টা করছে তারাও। কেউ কেউ পাগলের মত কাঁদছে। কেউ কেউ ভুতের মত সাদা মুখ করে রেখেছে। কিন্তু আপনাদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে ঘরের লিভিং রুমে বসে খোশ আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা কি আমার পিস্তলটাকে ভয় পাচ্ছেন না? নাকি আপনারা ভেবেছেন আমার মত দেখতে কেউ এই কাজে সফল হবে না তাই ভয়ের কিছু নেই? আপনারা কি ভাবছেন, এই ছেলে যে কিনা টি-বিশ্ববিদ্যালয়েই সুযোগ পায়নি আর সে কিনা প্লেন হাইজ্যাক করবে!”
“না একদমই না,” সেলসম্যান বলতে গেল। “আমরা ভাল ভয় পেয়েছি। যেমন উদাহরনস্বরূপ…”
“..আমি বলতে চাইছি, আপনার কথা আর কাজ দেখে মনে হচ্ছে সবকিছু নিয়েই আপনার জটিলতা আছে। যে কারনে আপনাকে ভারসাম্যহীন মনে হয়। এবং সেটা অবশ্যই ভয়ের ব্যাপার,” আমি বললাম।
“জটিলতা? আমি অতদুর যাব না। কিন্তু আমার সবসময় মনে হয় লোকজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, রাস্তায় আমার পাশ দিয়ে যে কুকুর হেঁটে যায়, টিভি শো এর হাইস্কুলের মেয়েরা-আমার মনে হয় সবাই জানে আমি কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছি, আর সবাই আমাকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসাহাসি করে।”
“হা হা…” সেলসম্যান বলল, আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যাতে মনে হল বলতে চাইছে এই ছেলে সত্যি সত্যি বিপদজনক। “আপনি খুবই সেনসিটিভ,” গলার স্বর কত্রিম শোনাল।– আমি চারপাশে তাকালাম। প্লেনের সবাইকে ভয়ে অসুস্থ দেখাচ্ছিল। কেউ সরাসরি আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল না কিন্তু এটা নিশ্চিত যে সবাই এখানে কি হচ্ছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল। কাছাকাছি বসে থাকা লোকজন মনে হচ্ছিল আমাদের কথাবার্তা শোনার জন্য কান পেতে আছে। আমি আবার অল্প বয়সি ছেলেটার দিকে তাকালাম আর বললাম, “আমাদেরকে অন্য যাত্রিদের মত আতংকিত লাগছে না তার কারন হয়ত আমাদের দুজনের আসলে অন্যদের মত হারানোর তেমন কিছু নেই।”
হাইজ্যাকার ছেলেটা এমনভাবে মাথা ঘোরাল যেন আরো বিস্তারিত জানতে চায়।
“হ্যাঁ আমি প্লেন ক্রাশ করে মরা নিয়ে ভীত, কিন্তু অন্যদের সাথে তুলনা করলে আমরা দুজন ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।”
আমি সেলসম্যানের দিকে ইঙ্গিত করে ব্যাখ্যা করলাম যে লোকটা আগেই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। আর আমার ক্ষেত্রে আমি বললাম যে হাই স্কুলে থাকতে এক লোক আমাকে রেপ করেছিল, আমি সেটার প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছিলাম। ছেলেটাও সব শুনে সেলসম্যানের মত হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
“এরপর থেকে আমি আর কোন পুরুষকে কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি।”
ছেলেটার চোখগুলো খানিকটা লালচে দেখাল। সে আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকল। কয়েকবার মনে হল সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। শেষ পর্যন্ত বলল, “যে লোকটা আপনার সাথে বাজে কাজ করেছে তাকে কি আপনি খুন করতে চাইছিলেন?”
“সম্ভবত। আমি চাই ওর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হোক। জানি না এছাড়া আর কিভাবে আমার শান্তি হবে। সে যাই হোক, এইসব কারনে এই সেলসম্যান ভদ্রলোক আর আমি নিজেদেরকে যাবতীয় সুখ থেকে মুক্ত করে ফেলতে পেরেছি। এখন যদি আমরা আমাদেরকে কোন সুখহীন বাস্তবতায় আবিষ্কার করি, যেমন জোর করে প্লেনক্রাশে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করা, তাহলে আমাদের আসলে কিছু যায় আসেনা।
“সেজন্যই আপনারা এত শান্তভাবে বসে কথা বলতে পারছিলেন।” হাইজ্যাকার ছেলেটা বলল।
সে চুপ করে বসে এক মুহূর্ত চিন্তা করল তারপর মাথা নামিয়ে বলল, “আপনার মন শক্ত। আপনার সাথে ভয়াবহ কিছু হয়েছে কিন্তু তারপরেও আপনি থেমে থাকেন নি। আপনি আপনার প্রতিশোধের ছক কেটেছেন, বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন।”
“কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে মরতে যাচ্ছি।”
যখন এটা বললাম, পাশে বসা সেলসম্যান আমাকে বলল, “হা হা হা, ভাল বলেছেন।”
আমি আরেকটু সামনে ঝুঁকে অল্পবয়সি ছেলেটার চোখের দিকে তাকালাম। এতে সে একটু অবাক হল আর একটু গুটিয়ে গেল।
“এখন আমাকে বলুন আপনার কেমন লাগছে? এই যে নিরীহ মানুষজন ভর্তি পুরো একটা প্লেন হাইজ্যাক করলেন।”
“ওকে এসব প্রশ্ন করবেন না!” সেলসম্যান বলল। ধাক্কা দিয়ে আমাকে সিটে পাঠিয়ে দিল।
“এক মিনিট দাঁড়ান, এটা জরুরী। প্রশ্নটা আসলে সে কাজটা করতে কতখানি মরিয়া। এরসাথে আমার ড্রাগটা কেনার সিদ্ধান্ত জড়িত।”
“ও আচ্ছা, তাহলে যুক্তি আছে।” সেলসম্যান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
“ভাগ? কি নিয়ে কথা বলছেন আপনারা?” ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।
সেলসম্যান আর আমি নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলাম, ছেলেটাকে ইয়থানাসিয়া ডাগ সম্পর্কে কিছু বলা ঠিক হবে কিনা। শেষে আমরা ওকে সব খুলে বললাম-হাইপোডারমিক, আমার কেনার চিন্তা, হাইজ্যাকিং ব্যর্থ হলে সেলসম্যানে লাভ, সবকিছু।