“একদম ছোট থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল একজন সেলসম্যান হব। স্বপ্নটা একটু অদ্ভুত, জানি। আমার শিক্ষকরাও আমাকে তাই বলেছিলেন। এর মধ্যে আকর্ষণটা কোথায় তা আপনি জানতে চাইতে পারেন। আমি শুধ বলতে পারি সেটা হল লোকজনের সাথে কথা বলার মধ্যে, তাদের কাছে। দরাদরি করে প্রোডাক্ট বিক্রি করার মধ্যে।”
“আপনার স্বপ্ন তাহলে সত্যি হয়েছে, আপনি তো এখন একজন সেলসম্যান।”
লোকটা মাথা ঝাঁকাল, কিন্তু মুখে হাসি নেই।
“কিন্তু সত্যি কথা হল, এই কাজের জন্য আমার কোন মেধা নেই। দশ বছর হয়ে গেল সেলসম্যান হিসেবে কাজ করছি, কোন উন্নতি দেখছি না। আমার পরে যারা শুরু করেছিল তারাও এখন আমার চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে। কোম্পানিতে আমার অবস্থান এখন মাত্র স্কুল থেকে বের হয়ে নতুন চাকরি পাওয়া একজনেরও নিচে। আমার স্ত্রী আমার উপর আশা ছেড়ে দিয়েছে। সে আমাকে ছেড়ে এখন টোকিওতে নিজের বাবা-মা এর সাথে গিয়ে থাকছে।”
“তারমানে আপনার মনে হচ্ছে যে আপনার জীবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যে কারনে আপনার উচিত আত্মহত্যা করা?”
লোকটা মাথা ঝাঁকাল।
“আমাকে বোঝে এমন একজনের সাথে কথা বলেছি। সে একজন ডাক্তার। তার কাছ থেকে অনেক টাকা দিয়ে এই ইয়থানাসিয়া ডাগ কিনেছি।
“কি ধরনের জঘন্য ডাক্তার হলে এমন কাজ করতে পারে?
“খুবই বয়স্ক আর খানিকটা ভ্রু ঢিলা ধরনের ডাক্তার হলে। ভাগটা হাতে পাওয়ার পর আমি এই প্লেনে চড়ে আত্মহত্যা করার জায়গাটায় যাচ্ছিলাম।”
“ও আচ্ছা আপনার প্ল্যান ছিল অন্য কোথাও গিয়ে আত্মহত্যা করার?”
“হ্যাঁ আমার প্ল্যান ছিল আমার শ্বশুরবাড়ির দরজার সামনে বসে আত্মহত্যা করার। আমার স্ত্রী বাসা থেকে বের হয়ে আমার মৃতদেহে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এরকম একটা দৃশ্য আমার চোখে ভাসছে। ব্যাপারটা ওর জন্য কঠিন শক হবে। আর ও বিশাল রকমের ঝামেলাতেও পড়বে। ওর প্রতিবেশীরা যে ওকে আর আগের মত পছন্দ করবে না, তা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।”
“কি ভয়াবহ!”
“আপনার সমালোচনা বরং আপনার কাছেই রাখুন। এদিকে আমার প্ল্যান মাঠে মারা গেল এই হাইজ্যাকিঙের জন্য। তাই ভাবছিলাম আপনি আমার ইয়ুথানাসিয়া ডাগটা কিনবেন কিনা। সেলসম্যান হিসেবে মৃত্যুর আগে আমার শেষ ইচ্ছা হল কারো কাছে কিছু একটা বিক্রি করতে পারা। আপনি আমার কাছ থেকে ডাগটা কিনলে আমিও শান্তি নিয়ে মরতে পারি।” সে দুঃখী দুঃখী চোখে বলল। বৃষ্টিতে ভেঁজা কুকুরের চোখে যেরকম দৃষ্টি থাকে।
আমি এক মিনিট চিন্তা করলাম। আইডিয়াটা খারাপ না কিন্তু। “কিন্তু ডাগটা নিশ্চয়ই অনেক দামী? কত?”
“আপনার পার্সে কত আছে?”
সিট থেকে মাথা না হলে আমি হ্যান্ডব্যাগ থেকে ওয়ালেটটা বের করলাম। তারপর খুলে লোকটাকে দেখালাম আমার কাছে কত আছে।
“তিনটা দশ হাজার ইয়েনের নোট আর কিছু ভাংতি। একটা ব্যাংক কার্ড দেখতে পাচ্ছি। একাউন্টে কত আছে?”
“প্রায় তিন মিলিয়ন ইয়েনের মত।”
“তারমানে সব মিলিয়ে তিন মিলিয়ন ত্রিশ হাজার ইয়েনের মত দিতে পারবেন।”
“এত্ত দাম! আমার সর্বস্ব চলে যাবে।”
“আপনি তো এসব নিয়ে কবরে যেতে পারবেন না। ভেবে দেখুন। আপনার ব্যাংক কার্ড আর পিন নাম্বারটা দিন।”
“দাঁড়ান দাঁড়ান, এক মিনিট। আপনি আর হাইজ্যাকার একসাথে কাজ করছেন তাই না? আপনাদের ধান্দা হল প্লেন হাইজ্যাক করে এই ডাগ বিক্রি করে টাকা পয়সা কামানো।”
সেলসম্যান নাক টেনে শব্দ করল। “আপনার ধারণা জালিয়াতি করার জন্য আমি এইসব খুনাখুনি করছি?” থুতনি নাড়িয়ে করিডোরে পড়ে থেকে এয়ারহোস্টেসের দিকে ইঙ্গিত করল।
“ঠিক আছে, আপনাকে বিশ্বাস করছি। কিন্তু তারপরেও আমার ধারণা একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ এর জন্য সর্বস্ব দিয়ে দেয়া বেশিই হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাকে দশ হাজার ইয়েন দিব। সেটাও আমার কাছে অনেক বেশি মনে হচ্ছে।”
সত্যি বলতে কি আমি ডাগটা চাই। আমি যদি সত্যি সত্যি মরার মুখে থাকি তাহলে এখন এসব টাকা আমার কাছে স্রেফ কিছু কাগজ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর লোকটাকে ব্যাংক কার্ড দিলেও সে টাকা তুলতে পারছে না, সে-ও তো একসাথেই মরবে। ও আর আমি তো একই প্লেনেই বসে আছি যেটা ক্রাশ করতে যাচ্ছে। এই ভাগ্য এড়ানোর কোন উপায় নেই। কিন্তু আমি জিদ ধরে থাকলাম।
“আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? তিন মিলিয়ন ত্রিশ হাজার ইয়েন! খুবই বাড়াবাড়ি।”
“এরকম একটা সময়ে আপনি দাম নিয়ে মুলোমুলি করছেন? আমি যদি এই জিনিস এখন দশ হাজার ইয়েনে বিক্রি করি তাহলে আমার আত্মা শান্তি পাবে? পরের জন্মে আর জেগে উঠতে পারবে?”
“আপনার আত্মার কথা জানি না,” আমি বললাম, “কিন্তু আমার পুরো জীবন চলেছে লোকজনকে দাম কমানোর কথা বলে। দিনের পর দিন আমি সবজির দোকানে কিংবা মাছের দোকানে গিয়ে লোকজনের সাথে দাম কমানো নিয়ে মুলোমুলি করেছি। এখানেই আমার আনন্দ। আমি বলতাম বাঁধাকপিতে পোকা, কিংবা মাছটা একটু নরম হয়ে গিয়েছে। কোন না কোন একটা খুঁত ধরে আমি একটু সস্তায় কেনার চেষ্টা করতাম। পুরো দিনের মধ্যে ওই একটা সময়েই আমার যা একটু মানুষের সাথে যোগাযোগ হত।”
“কি দুঃখজনক জীবন। আপনি যেখানে কাজ করেন সেখানে কারো সাথে কথা বলেন না?”
“না, একদমই না। আমি একটা মাঙ্গা ক্যাফেতে পার্টটাইম কাজ করি। কেউ আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে আমি তাকে উপেক্ষা করি। আমি ওই ধরনের মানুষ যারা সবসময় অন্যদের ভয় পায়। সেজন্যই একা থাকি, বিয়েও করিনি।”