ক্যানটা কেবিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত গড়াতে থাকল। একবার একজনের পায়ের নিচে পড়লে ছিটকে গিয়ে আবার অন্য কোথাও গিয়ে পড়ত।
“ছেলেটা আসলে বেশ লাকি,” আমার পাশের লোকটা বলল। এখনো সিটের পিছনে লুকিয়ে আছে। প্রায় সব যাত্রিই সিটের পেছনে মাথা নিচু করে রেখেছে। যদি কোনভাবে কোন বুলেট ছিটকে গিয়ে লাগে এই ভয়ে।
“সবার পা গিয়ে কেন ওই শালার খালি ক্যানটার উপরই পড়ছে? সবাই বোধহয় তাদের প্ল্যান নিয়ে এতটাই মগ্ন যে পা কোথায় ফেলছে সেদিকে খেয়াল নেই।”
হাইজ্যাকার যদি এই আলোচনা শুনতে পায় তাহলে আমাদেরকে কি বলতে পারে সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। তবে আমি নিশ্চিত যে যতক্ষণ আমরা সিটের পেছনে আমাদের মাথা নিচু করে রাখছি ততক্ষন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে না।
“আমার মনে হয় শুধু যাদের পা নেই তারাই খালি ক্যানে পা ফেলবে না,” লোকটা মন্তব্য করল। “যেমন ভুত। কিন্তু তবুও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এই ছেলে আমাদেরকে জোর করে ওর সুইসাইড ট্রিপে নিয়ে যাচ্ছে।”
“আপনার কি মনে হয় এই প্লেন সত্যি ধসে পড়তে যাচ্ছে?”
“গল্প-উপন্যাস হলে কোন এক একশন হিরো এসে পরিস্থিতির দখল নিত।”
“আপনি বলতে চাইছেন সে আমাদেরকে রক্ষা করত?”
বলতে গেলে, যদি কোন ছোট গল্পের বইয়ের শেষটা তাড়াহুড়া করে লিখতে হয় তাহলে এরকমই সমাপ্তি হওয়া উচিত। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আমরা সবাই ক্রাশ করতে যাচ্ছি। টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলো আজ ভয়াবহ আতংকের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।”
লোকটা তার তর্জনী কপালে ঠেকিয়ে এদিক ওদিক মাথা নাড়াল যেন শোক প্রকাশ করছে। নাটুকে অঙ্গভঙ্গি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই প্লেনে চড়ার পেছনে আমার অন্য একটা কারন আছে। আর সেটা হাইজ্যাক হওয়া নয়।
প্লেন ক্রাশ করে মরার আইডিয়াটা আমার পছন্দ হল না। একদম ছোটবেলা থেকে পুরোটা জীবন ভেবে এসেছি শান্তির সাথে মৃত্যুবরণ করব। আকাশে কখনো তারা খসে পড়তে দেখলে আমি কখনো সুখি বৈবাহিক জীবন কিংবা সফল ক্যারিয়ার চাইনি। বরং আমি চেয়েছি আমার মৃত্যু হোক ঘুমের মধ্যে।
“মরতে যাচ্ছি এই চিন্তাটা আমার কোনভাবেই হজম হচ্ছে না, আমাদের কি কিছুই করার নেই?”
“জানি কি বলতে চাইছেন। যে মুহূর্তে আমরা হিট করব, বর্ণনাতীত ব্যথা অনুভূত হবে। আমাদের হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়ো গুড়ো হয়ে যাবে। শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসবে, আগুনের শিখা আমাদেরকে খেয়ে ফেলবে। পুরোটাই জঘন্য ব্যাপার।”
“তরও অন্তত আশা করছি তাড়াতাড়ি মরব…”
“সেটা তো সহজ!” লোকটা উৎসাহের সাথে বললেও গলার স্বর নিচু রাখল যাতে হাইজ্যাকার শুনে না ফেলে। “তাড়াতাড়ি মরতে চাওয়া কোন সমাধান না। কে জানে কপালে কি আছে? ও যদি কোন ভুল করে আমরা হয়ত তাহলে বেঁচে যেতেও পারি। কিংবা হয়ত ডালপালায় ঝুলে থেকে নাড়িভুড়ি বের হয়ে কয়েক ঘন্টা ভুগে ভুগে মরব।”
হঠাৎ আমার চোখের সামনে আমার মৃত্যুদশা ভেসে উঠল মনে হল। কষ্টে মোচড়াচ্ছি, বমি বমি ভাব হচ্ছে, আর বগল ঘামে ভিজে আছে।
“আমার ক্ষমতার মধ্যে থাকলে, আমি অবশ্যই শান্তিময় মৃত্যু বেছে নিতাম।”
আমার অধৈর্য বিড়বিড় শুনে লোকটা আঙুল দিয়ে এমনভাবে ঠকঠক শব্দ করল যেন ছেলেটা শুনতে না পায়।
“এই কথাগুলো শোনার জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম।” সে বলল।
আমি একটু সরে বসলাম।
“কি বলতে চাইছেন? আঙুল দিয়ে তবলা বাজাচ্ছেন যেন খুব ফুর্তিতে আছেন? কমন সেন্স না থাকারও একটা লিমিট আছে!”
“মাফ করবেন। আমি বোধ হয় আপনাকে এখনো বলিনি, আমি একজন সেলসম্যান।”
লোকটা তার সুট এর পকেট থেকে কিছু একটা বের করল। তারপর মুখটা আমার কাছে আনল।
“এটা দেখুন।”
লোকটার হাতে একটা ছোট সাইজের হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ, ভেতর স্বচ্ছ কোন তরল ভরা।
“এটার একটা শট নিলে যে কেউ কষ্টবিহীন মৃত্যুবরণ করবে। আমার কাছে আর এই একটাই আছে। আপনি কি কিনতে চান?”
কেউ একজন সিট থেকে উঠে অল্পবয়সি ছেলেটার থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করল। তারপর আমাদের কানে খালি ক্যানটা নড়ার শব্দ এল। তারপর গুলির শব্দ।
২
“আপনি বলছেন সিরিঞ্জের ভেতরের ডাগটা ইয়থানাসিয়া? যন্ত্রণাবিহীন মৃত্যু দিতে পারবে?”
“ঠিক তাই। আপনি যদি প্লেন ক্রাশ করার আগেই এই ইনজেকশনটা গ্রহণ করেন তাহলে কোন ভয়, কোন অনুভূতি ছাড়াই মৃত্যুবরণ করতে পারবেন। কিন্তু যদি কিনতে চান তাহলে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
“কেন?”
“কারন ডাগটা কাজ করতে আধা ঘন্টার মত সময় লাগে। যদি ধরে নেই প্লেন ক্রাশ করার আগে আমাদের হাতে এক ঘন্টার মত সময় আছে তাহলে আপনার হাতে ত্রিশ মিনিটের মত সময় আছে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। নাহলে ডাগটা ঠিক মত কাজ করবে না, আর আপনিও অন্য জগতে যাওয়ার আগে টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখা পাবেন। সুতরাং সময় নষ্ট করবেন না।”
“আপনি আসলে কে বলুন তো? আজরাইল নাকি?”
“আমি সেফ সাধারণ একজন সেলসম্যান। আপনার নিশ্চয়ই অদ্ভুত লাগছে ভেবে যে কেন আমার কাছে একটা ইয়থানাসিয়া ডাগ আছে? আচ্ছা, এখন আপনাকে বলতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি আসলে আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা করছিলাম।”
হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা স্যুটের পকেটে রেখে লোকটা দূরে কোথাও তাকিয়ে নিজের গল্প বলা শুরু করল।