***
আধঘণ্টা আগে প্লেনটাকে হাইজ্যাক করা হয়েছে। টেক অফের কিছুক্ষণ পরই। অল্প বয়সি এক যুবক, দেখে মনে হয় কলেজের ছাত্র, প্লেনের সামনের দিকে বসে ছিল। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে লাগেজ ব্যাক থেকে কিছু একটা বের করতে থাকে। কেবিন ক্রু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে বসতে বলে। ছেলেটা ব্যাগ থেকে পিস্তলের মত কিছু একটা বের করে মেয়েটার বুকে চেপে ধরে।
তারপর অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে, যেমন “ব্যাপারটা ভুলে যাও, ভুলে যাও। আমাকে ভুলে যাও। আমাকে ভুলে যাও।”
ছেলেটা রঙ ওঠা পুরনো ময়লা একটা সোয়েটার পরে ছিল। তার উপরে একটা সাদা কোট। চুলগুলো কোঁকড়া। মাঝখানের এক ফালি চুল এন্টেনার মত খাড়া হয়ে ছিল। পিস্তল ধরা হাতটা কাঁপছিল। সত্যি বলতে কি পিস্তলটা দেখে আমার কাছে মনে হচ্ছিল নকল, মনে হচ্ছিল ওয়াটার গান ধরে আছে।
“ভুলে যেতে পারব না, এটাই আমার চাকরি। আমাকে আমার কাজ করতে হবে,” ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট পিস্তলের ব্যারেল উপেক্ষা করে বলল। মনে হয় মেয়েটাও আমার মত পিস্তলটাকে খেলনা ভেবেছিল। ছেলেটা পিছিয়ে গেল। মনে হল সিটে বসতে যাচ্ছে।
ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট সামনে এগিয়ে গেল যেন ছেলেটার সাথে জিতে গিয়েছে। নিজেকে কি মনে করেন আপনি? সিট বেল্ট বেঁধে রাখার সাইন এখনো অন। আপনি কি ভেবেছেন এখন সিট ছেড়ে উঠলে কি আসে যায়? আর এসব কি পোশাক? মাঝে মধ্যে দু-একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিন তো খুলে দেখতে পারেন, নাকি? কি জঘন্য অবস্থা!”
বাকি সব যাত্রি ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টকে ছেলেটাকে ঝাড়তে দেখে মজা নিচ্ছিল। ছেলেটা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর পিস্তলটা কেবিন অ্যাটেন্ডেন্টের দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে দিল। শুকনা একটা ধপ শব্দ হল আর মেয়েটা কলাগাছের মত করিডোেরে পড়ে গেল। যাত্রিদের হাসি হাসি মুখ মুহূর্তেই হাঁ হয়ে গেল। তাদের কিছুই করার ছিল না হাঁ করে দেখা ছাড়া। অপরিচ্ছন্ন পোশাক পড়া ছেলেটা করিডোর দিয়ে ককপিটের দিকে এগিয়ে গেল।
যাওয়ার সময় সে বলতে লাগল, “কেউ নড়বেন না, প্লিজ। যে নড়বেন তাকে আমি গুলি করব। পাইলটের সাথে আমার কিছু কথা আছে। আপনাদের সাথে এরকম করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।”
সে সামনে পেছনে কয়েকবার তার মাথা ঝাঁকাল। আর হাঁটার মধ্যেও কেমন একটা অদ্ভুত নার্ভাস ভঙ্গি ছিল। প্লেনের সামনের দিকে বসা একটা লোক উঠে দাঁড়াল। সুন্দর একটা সুট পড়া সুদর্শন এক যুবক।
“এক মিনিট দাঁড়াও!” লোকটা গম্ভীর গলায় আদেশের সুরে বলল। ছেলেটা থামল, ওকে হতভম্ব দেখাচ্ছিল।
“কি..?”
“এটা মজা করার কোন ব্যাপার না। খেলনা দিয়ে স্টুয়ারডেসকে ভয় দেখাচ্ছিলে আর সেজন্য ক্ষমা চাওনি?”
“যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু কিছু আসে যায় না,” ছেলেটা বলল। “আপনার সুটটা দারুণ। বাজি ধরে বলতে পারি আপনি ভাল কোন কলেজে পড়েছেন। পাশ করার পর ভাল চাকরি করছেন, ওর গলায় ঈর্ষা।
“ঠিকই ধরেছ। আমি টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়।”
ছেলেটা পিস্তল তুলে লোকটাকে গুলি করল। তারপর যাত্রিদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল আর কেউ টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে কিনা। কেউ হাত তুলল না। ছেলেটা ঘুরে ককপিটে ঢুকে গেল। ছেলেটা অদৃশ্য হতেই কেবিনের যাত্রিদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেলেটা ফিরে এলে আবার সবাই চুপ হয়ে গেল।
“সবাই শুনুন প্লিজ। আমি জানি আপনারা কেউ কেউ হয়ত বাড়িতে ফিরছেন অথবা কোথাও ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন। কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে আমি এই ফ্লাইটের গন্তব্য বদলে দিয়েছি। হানেদা এয়ারপোর্টের বদলে আমরা এখন যাচ্ছি টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র হলগুলোর দিকে।”
এক মুহূর্তের জন্য থেমে সে সবাইকে কথাগুলো হজম করার সুযোগ দিল। তারপর আবার শুরু করল। “আর দেড় ঘন্টার মধ্যে আমরা ক্যাম্পাসের বিল্ডিংগুলোর উপর ক্রাশ করব। আমি আপনাদেরকে আমার সাথে মৃত্যুবরণ করার জন্য আহবান করছি। প্লিজ। পর পর পাঁচ বার আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছি। মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আমার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।”
কলেজের ছাত্রর মত দেখতে ছেলেটা আসলে কলেজের ছাত্র ছিল না। সে ছিল বেকার আর মরিয়া। আর আমরা, যাত্রিরা ওর আত্মহত্যার প্ল্যানে আটকা পড়েছি।
***
আরেকবার গুলির শব্দ হলে আমি আর ধূসর সুটের লোকটা এক সাথে করিডরের দিকে তাকালাম। ছেলেটা বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। সামনে একটা লাশ পড়ে আছে। আমি বললাম কেউ নড়বেন না! তারপরেও কেন নড়ছেন?!”
গুলির শব্দে হাত দিয়ে কান ঢাকা যাত্রিদের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করল সে। সযোগ আছে ভেবে কয়েকজন যাত্রি সিট থেকে পেছন থেকে আক্রমণ করার চিন্তা করেছিল। ছেলেটার চেহারার অধৈর্য অভিব্যক্তি যেন বলছিল, “চেষ্টা করেই দেখুন খালি!” দেখে মনে হচ্ছিল ছেলেটাকে কাবু করা সহজ কাজ হবে। এমনকি আমিও, যার শরীরে শক্তি কম, আমারও ইচ্ছা করছিল একবার চেষ্টা করে দেখতে। ছেলেটার মধ্যে কিছু একটা ছিল যা দেখে মনে হচ্ছিল সে জীবনের সব আশা ছেড়ে দিয়েছে।
কিন্তু তারপরেও, ছেলেটাকে ধরার জন্য যে কয়জন চেষ্টা করেছিল তাদের সবাইই কেবিনে গড়াতে থাকা একটা খালি ক্যানে পিছল খেয়ে পড়ল। তারপর ছেলেটা গুলি করে তাদের নড়াচড়া পুরোপুরি থামিয়ে দিল।