আমি তখন জানালা দিয়ে বাইরের মেঘ দেখছিলাম। চোখ সরিয়ে এনে আমার পাশে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকালাম। তার পরনে ম্যাটম্যাটে ধূসর বর্ণের সুট। আর চেহারাটা একদম বৈশিষ্ট্যহীন। শহরের রাস্তায় বের হলে এরকম লোক প্রচুর দেখা যায়। লোকটার বয়স ত্রিশের মত হবে, তারমানে আমার মতই বয়স।
“ভবিষ্যৎবানী? আপনি বলতে চাইছেন ওই যে ১৯৯৯ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে ওই ধরনের কিছু?”
লোকটা মাথা ঝাঁকাল।
“হ্যাঁ, ওসব জানি,” আমি বললাম। “যখন ছোট ছিলাম তখন এসব নিয়ে অনেক হৈচৈ হত। কিন্তু..মাফ করবেন,” সিট আর মাঝের করিডরের দিকে চোখ বুলিয়ে বললাম আমি, “আপনার কি মনে হচ্ছে না এরকম কিছু নিয়ে কথা বলার জন্য এখন সময়টা আসলে ঠিক নয়?”
“আসলে ঠিক করে বললে এই সময়টার কারনেই আমি বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাইছি।”
আমাদের সারিতে তিনটা সিট। এক জনের জন্য একটা করে। আমি বসেছিলাম জানালার পাশের সিটে। লোকটা বসেছিল মাঝখানের সিটটাতে। করিডরের সাথের সিটটা খালি ছিল।
“এটা কি কোন ধরনের খাতির জমানোর চেষ্টা নাকি?”
“একদমই না। আমি বিবাহিত,..যদিও আমার স্ত্রী আর আমি এখন আর একত্রে বসবাস করছি না,” লোকটা কাঁধ ভাগ করে বলল। “নস্ট্রাডামুসের কথা যেটা বলছিলাম। উনার ভবিষৎবাণীর উপর আমার অনেক বিশ্বাস ছিল। আমি আসলেই বিশ্বাস করতাম যে ১৯৯৯ সালে মানবজাতি ধুয়ে মুছে বিলিন হয়ে যাবে। আমার মনে হয়েছিল আমি নিজেও বাঁচব না।”
“আমারও তাই,” আমি বললাম। “হাইস্কুলে পড়ার সময় নস্ট্রাডামস সম্পর্কে জানতে পারি। উনার ভবিষ্যত্বাণী শুনে এতটা আতংকিত হয়েছিলাম যে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। সত্যি সত্যি মনে হয়েছিল যে আমি মারা যাব, আমার বাবা-মা মারা যাবেন। এর আগ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল মৃত্যু খালি অন্য মানুষদের হয়। কিভাবে ১৯৯৯ সালে আমার বয়স একুশ হবে তা নিয়ে খালি ভাবতাম আমি।”
লোকটা কাঁধ সোজা করে তাকাল। চোখে অবাক দৃষ্টি। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পুরোপুরি কুইজ শো এর হোস্টদের মত।
“তারমানে আপনি আমার বয়সি। একই স্কুল ইয়ার।”
“তাই বুঝি? একুশের পর জীবন নিয়ে আমার কাছে কোন প্ল্যান ছিল না।”
“কিন্তু শেষ তো হয়নি নাকি? পৃথিবীর কথা বলছি। হতে পারে অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি কিন্তু তখন থেকে আমার মনে হয় আমাকে হয়ত অতিরিক্ত কিছু সময় দেয়া হয়েছে আরো কয়েক বছর বাঁচার জন্য।” লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, গলা ভারি শোনাল। আমরা প্লেনের সবচেয়ে পেছনের সারিতে বসে আছি। আমার বাম পাশের জানালা দিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিল। নিচে ঘন সাদা মেঘ, ভেড়ার লোমের মত ঘন। বেশ শান্তিময় একটা দৃশ্য, স্বর্গের দৃশ্য ঠিক যেমনটা হতে পারে বলে আমি কল্পনা করেছিলাম।
“ব্যাপারটা একটু ক্লান্তিদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে,” লোকটা মলিন হেসে বলল। আমরা সামনের দিকে ঝুঁকে সিটের পেছনে লুকিয়ে ছিলাম। কাঁধের সাথে কাঁধ লাগিয়ে নিচু গলায় কথা বলছিলাম। দেখে মনে হতে পারে কোন বয়স্ক দম্পতি, চাইলেও যাদের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই।
“আমার মনে হয় না এছাড়া আমাদের আর কিছু করার আছে।”
লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল আর দুই সিটের মাঝখানের ফাঁকে মুখ চেপে ধরল যাতে করিডর দেখা যায়, যেটা আসলে দৃষ্টিকোনের কারনে সম্ভব হচ্ছিল না। এ অবস্থায় সে আমাকে বলল, “আমি অনেক দিন থেকেই আসলে কথাটা ভাবছি, এই প্লেনে ওঠার অনেক আগে থেকেই। নস্ট্রাডামুসের ভবিষ্যত্ববানী মিথ্যা প্রমানিত হওয়ার পর ১৯৯৯ থেকে যেসব নতুন শিশুর জন্ম হয়েছে তারা মৃত্যু নিয়ে কি ভাবে? আমি একদম নিশ্চিত যে মৃত্যুর ব্যাপারে তাদের ধারণা আপনার আমার থেকে আলাদা। যারা ১৯৯৯ এর আগে জনুগ্রহন করেছিল তাদের মাথার উপর ওই ভবিষ্যত্ববানী খড়গের মত ঝুলছিল। আমাদের উপর অভিশাপের ছায়া ফেলছিল। এমনকি যেসব শিশু-কিশোর ব্যাপারটা বিশ্বাস করত না, তাদের মনেও কিছুটা সন্দেহ ছিল। কিন্তু এখনকার বাচ্চারা একদম আলাদা। দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেল কিনা কিংবা তারা মারা যাবে কিনা এসব নিয়ে তাদের মনে কোন চিন্তা নেই।”
“আপনার তাই মনে হয়?” আমি বললাম। “নস্ট্রাডামুসকে বাদ দিলেও আরো হাজারটা জিনিস আছে যার কারনে ওদের মনে ধ্বংস কিংবা মৃত্যুর চিন্তা আসতে পারে। প্রতিদিনই গাড়ি দুর্ঘটনা হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগও আগের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। আমার অন্তত তাই ধারণা।”
লোকটা বড়জোর এক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে তাকাল।
“আপনার যুক্তি বুঝতে পারছি। হয়ত ঠিকই বলছেন।” সে আবার তার মুখ সিটের ফাঁকে চেপে ধরল সামনে দেখার জন্য। মুখে তখনো মলিন হাসি। প্লেনটা একটু কাত হল। একই সময়ে আমরা একটা ক্যান গড়ানোর শব্দ পেলাম। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই এরকম হচ্ছে। প্রতিবার প্লেনটা কোনদিকে একটু কাত হলেই একটা ক্যান সামনে পেছনে গড়াগড়ি করছে।
“কখনো কল্পনাও করিনি যে কোন প্লেন ক্রাশে আমার মৃত্যু হবে। আপনি করেছেন? আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এই প্লেনটা কোথাও আছড়ে পড়বে। আপনার কি মত?”
“হ্যাঁ, ভয়ের ব্যাপার। এখনো অনেক কিছু বাকি আছে যা আমি করতে চাই। প্লেন ক্রাশে মৃত্যু…নাহ…এখনো বিশ্বাস ক ব্যাপারটা।”
আমি কাঁধ যাগ করে মাথাটা একটু তুললাম যাতে সিটের উপর দিকে সামনে কি হচ্ছে তা দেখতে পারি। নিউ ইয়ার কিংবা ওবনের (জাপানি বুদ্ধিস্ট অনুষ্ঠান) সময় হলে প্লেন ভর্তি থাকত। কিন্তু বছরের এই সময়ে প্লেনের মাত্র অর্ধেকের মত ভর্তি ছিল। হাতে পিস্তল করিডোরে নিয়ে একজন হাইজ্যাকার দাঁড়িয়ে আছে।