রিয়ুজির রুমটা মূল বাড়ি থেকে আলাদা। ওর দরজার ঠিক বাইরেই একটা বাগান। রাতের বেলা ঠাণ্ডা বাতাস এসে রুমের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলে।
মিকি ঐ দরজা দিয়েই এসে ঢুকল। ওর কাঁধ থেকে একটা হালকা কোট ঝুলছিল। নভেম্বরের শীতল রাতের মধ্যে সে সরাসরি ট্রেন স্টেশন থেকে এখানে এসেছে। মেয়েটার ডান হাতে লাল রঙের একটা বড় সুটকেস ধরা। ও মেঝের উপর বসে পড়ল।
“আমি এখনও বাড়ির ভেতর পা ফেলিনি। একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। তোমাদের বাড়িটা একদম পাহাড়ের মাথায়। এতটুকু হেঁটে আসতে গিয়ে আমি এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে আর পা নাড়াতে পারছি না।”
“সুটকেসটা তো বেশ বড়। তুমি কি এই পুরনো বাড়িতে পাকাপাকিভাবে চলে আসার ধান্দা করছ নাকি? আমার অবশ্য তাতে কোন সমস্যা নেই। আর আমি নিশ্চিত যে বাবা-মা এতে খুশিই হবেন। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে একসাথে থাকতে তোমার কেমন লাগবে?”
পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে সুটকেসটায় আলতো ধাক্কা দিয়ে মিকি বলল, “তোমার সাথে দেখা করতে আসার আগে আমার এটা ইশিরোর রুমে রেখে আসার কথা।” ও এমনভাবে রিয়ুজির দিকে তাকাল যেন সে কোন নোংরা জন্তু। বাম হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের সামনে ধরে রাখল। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে ও এরকম করে। রিফুজি হেসে ওকে সোফায় এসে বসার আমন্ত্রণ জানাল।
“বেশি সময় লাগবে না। এখনই তো নয়টা বেজে গিয়েছে।” যেই মাত্র রিয়ুজি কথাটা বলল তখনই ঘড়িতে শব্দ করে নয়টা বাজল। “আমাকে অবশ্য আজকে রাতে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যেতে হবে। তুমি তো বোধহয় এই বাড়িতে দ্বিতীয়বারের মত এলে, তাই না?”
“তৃতীয় বার, যদি বিয়ের দিনটা ধর।”
“ভাইয়ার সাথে তোমার সব কেমন যাচ্ছে? ও কি তোমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে?”
রিয়ুজি দরজার দিকে এগুলো। ও সাইজে ছোটখাট একজন মানুষ, হাঁটেও ছোট ছোট পদক্ষেপে।
“দরজা লক করছো কেন?”
“এটা আমার স্বভাব। এই ওয়ারড্রবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রাখা আছে, তাই আমি সবসময় দরজা লক করে রাখার চেষ্টা করি।”
“কিন্তু রুমটা পরিস্কার রাখার ব্যাপারে তোমার যে একদমই কোন চিন্তা নেই তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দেখে মনে হচ্ছে এখান দিয়ে কোন টাইফুন বয়ে গিয়েছে।”
মিকি রুমের মধ্যে চোখ বুলাল। রুমটা বেশ বড়, কিন্তু সবকিছু এলোমেলো। কাঠের মেঝেতে যেখানে সেখানে জামাকাপড়ের স্তূপ পড়ে আছে। এক কোনায় একটা মরচে ধরা লোহার বিছানা আর একটা কাঠের ডেস্ক-চেয়ার। ডেস্কের উপর একটা পুরোনো টাইপরাইটার। টাইপরাইটারের আশপাশ দিয়ে বইয়ের স্তূপ।
“তুমি কি এখানেই কাজ কর?”
“হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়।”
রুমের মাঝামাঝি একটা লেদারের সোফা সেট রাখা। সেটার আশেপাশে আরো জামাকাপড়। যেখানে খোলা হয়েছে সেখানেই ফেলে রাখা হয়েছে। সোফার পাশে একটা নিচু কফি টেবিল। টেবিলের উপর আধ-খালি কফি কাপ রাখা। ধোঁয়া নেই দেখে মনে হচ্ছিল কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।
“ঐ দরজাটা দিয়ে কি বাইরের ছাউনিতে যাওয়া যায়?” বিছানার পাশের দরজাটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে মিকি জানতে চাইল।
“ঠিক ধরেছ। যা যা ব্যবহার করি না সেগুলো ওখানে নিয়ে রাখি। সবকিছু। আমার বই, ভাইয়ার পেইন্টিংগুলো। দেখতে চাও? ছাউনিটা একজনের থাকার জন্য যথেষ্ট বড়।”
মিকি মাথা নাড়ল। “অন্য কোন সময় দেখব নে।”
রুমটায় একটাই জানালা ছিল, বন্ধ করা। পর্দাগুলো পুরো সরিয়ে দেয়া ছিল যেকারনে রাতের অন্ধকারে জানালাটাকে আয়নার মত দেখাচ্ছে। মিকি ওর নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছে।
“কাঠের ওয়ারড্রবটা। ওটাকে চেনা চেনা লাগছে-ইশিরোর রুমেরটার মত একদম দেখতে, তাই না? দরজার উপর একই রকম কাঠের কাজ করা।”
“আমার বড় দাদি ওগুলো আমার জন্য একটা আর ভাইয়ার জন্য একটা কিনেছিলেন। এই ওয়ারড্রবগুলো লক করা যায়। মাঝে মাঝে অবশ্য লক ঠিকমত কাজ করে না।”
“ওগুলো দেখতে খানিকটা ভুতুড়ে মনে হয় না? বিশাল একটা কালো রঙের বাক্সর মত লাগে। ফুয়ুমির রুমেও কি একটা আছে?”
“না, ফুয়ুমির জন্মের আগেই বড় দাদি মারা গিয়েছিলেন।”
এই পরিবারে দুই ছেলে এক মেয়ে। তিনজনের মধ্যে শুধু ছোট ছেলে, রিয়ুজি এখানে বাবা-মায়ের সাথে থাকে। ও একজন ঔপন্যাসিক।
“ইশিরো কোথায়? ওর তো গতকাল আসার কথা।”
“ও তো বলল একটু হাঁটতে যাচ্ছে। খারাপ হল। এক ঘন্টা আগে পর্যন্ত ও আমার রুমেই ছিল। একটুর জন্য তোমাদের দেখা হল না। ও যখন বেরিয়ে যায় তখন আমি ছাউনিতে ছিলাম। ঐ জায়গাটা এই রুমের চেয়ে একটু বেশি গোছানো। যে কারনে ওখানে বসে পড়াশুনায় মনোযোগ বসাতে আমার কাছে সহজ মনে হয়। ইশিরো ঠিক কখন বেরিয়েছে তা বলতে পারব না, কয়েক মিনিট আগে ছাড়া আমার দরজা লক করার কথা মনে ছিল না।”
নার্ভাসভঙ্গিতে নিজের নখ কামড়াতে কামড়াতে রিয়ুজি লকটা আবার চেক করল ঠিক দিকে মুখ করে আছে কিনা। স্টেরিওটা তুলে সেটায় একটা সিডি ভরল। তারপর সোজাসুজি মিকির সামনে বসে পড়ল। মিউজিকটা একটু বেশিই জোরে বাজছিল কিন্তু রিয়ুজির সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। ওর রুমটা মূল বাড়ি থেকে যথেষ্ট দূরে হওয়ায় অন্য কারোরও বিরক্ত হওয়ার কথা না। মিকি কথাটা বলার আগে এক মুহূর্ত ইতস্তত করল, ওর দৃষ্টি স্থিরভাবে কোন কিছুর উপর ছিল না।