রুমের কোনায় রাখা টিভিটায় তখন দুপুরে ঘটা হাইজ্যাকিঙের খবরটা দেখাচ্ছিল। একটার পর একটা ছবি ভেসে আসছিল-প্লেন ল্যান্ড করার দশ্য, যাত্রিদের বের করে নেয়ার দৃশ্য, পলিশের প্রবেশের দৃশ্য ইত্যাদি। যাত্রিদের ছবির সময় এক ঝলক আমি আমার আর সেলসম্যানের চেহারা দেখতে পেলাম।
“আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য ফ্লাইট ছিল এটা,” প্লেন থেকে নামার পর সেলসম্যানকে বলতে শুনেছিলাম কথাটা। সে দু পা দিয়ে মাটিতে বাড়ি দিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিল যে আসলে শক্ত মাটিতে আবার ফিরে এসেছে। “আশা করছি আবার অনেকদিন মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে না।”
আমাকে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল কারন আমি নিজের বাহুতে অজানা কোন তরল ইনজেক্ট করেছিলাম বলে আমাকে পরীক্ষা করা দরকার ছিল। আমার সাথে আরো অনেক যাত্রিকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল, মূলত বিভিন্ন সময়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার কারনে।
আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি, ভাবলাম। এমন সময় আমার কোলে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটা একটু নড়ে উঠল। আমার বুকে মুখ চেপে থাকল। দেখে মনে হচ্ছিল সুখি। একটা কন্ডোমিনিয়াম বিল্ডিঙের তিন তলায় এই অ্যাপার্টমেন্ট। জানালাগুলো দক্ষিণমুখি। যে কারনে রুমগুলোতে বেশ আলো ঢোকে। জানালার কাছে ফুলদানিতে কিছু ফুল রাখা। ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মূল দরজা খোলার শব্দ কানে এল।
“কই সবাই? আমি চলে এসেছি।” একজন পুরুষের কণ্ঠ, যা আমি স্কুলের পরে আর শুনিনি, কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আমি হল দিয়ে তার পায়ের শব্দ ভেসে আসতে শুনলাম। তারপর লিভিং রুমের দরজা খুলে গেল। সে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল আমি ফ্লোরে বসে আছি আর ওর কন্যা আমার কোলে ঘুমাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টি মিলিত হল। আমার স্মৃতির সাথে ওর চেহারার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আমি বলব না অনেক আগে সে আমার সাথে কি কি করেছিল কিন্তু সেই ক্ষতগুলো এখনও আমার শরীরে, আমার মনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে।
“স্বাগতম,” আমি বললাম। এক মুহূর্তের জন্য সে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখল। কিন্তু আমাকে মনে পড়তে তার বেশি সময় লাগল না। আর
সে এক পা সামনে এগুলো।
“তু..তুমি এখানে কি করছ…”
“আমি তোমাকে খুঁজে বের করেছি,” আমি বললাম। পাশে রাখা ছুরিটা হাতে নিলাম। এখানে আসার পথটা বেশ এডভেঞ্চারাস ছিল অবশ্য। আমার প্লেন হাইজ্যাক হয়েছিল, গোলাগুলি হয়েছিল…”
“আমার স্ত্রী কোথায়…” আমার হাতে ছুরি দেখে সে থেমে গিয়ে প্রশ্ন করল।
“শপিঙে, সম্ভবত। সে তোমার মেয়েকে এখানে একা রেখে গিয়েছে।” আমি ছুরিটা ঘুমন্ত মেয়েটার গলার কাছে ধরলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার নাম টিভিতে বলল। আমি স্ক্রিনের দিকে তাকাতে দেখলাম আমার চেহারার একটা ক্লোজআপ ছবি স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে। খবর পাঠক বলছিল উদ্ধারকৃত যাত্রিদের একজন আমি, আমাকে কিভাবে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, তারপর আমি নিখোঁজ। আমার মনে পড়ল পুলিশ হাসপাতালের রুমের বাইরে অপেক্ষা করছিল কিছু প্রশ্ন করার জন্য। আমি বলেছিলাম আমাকে টয়লেটে যেতে হবে, তারপর সোজা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাই। সে টিভির ছবির সাথে আমার চেহারা মিলিয়ে দেখল।
“তুমি কি পরিকল্পনা করছ?”
“আশ্চর্যজনক সব ঘটনা, আর তার সাথে কিছু দুর্ভাগ্য। তুমি কি কখনো ভেবেছিলে যে এরকম কোন কিছু তোমার সাথেও হতে পারে?”
“প্লিজ, আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।” সে হাঁটু মুড়ে ফ্লোরে বসল। কাঁদতে কাঁদতে সে আর তার বন্ধুরা আমার সাথে হাই স্কুলে যা করেছে তার জন্য মাফ চাইল। রুমের ভেতর একমাত্র শব্দ ছিল ওর ফোঁপানোর শব্দ। তারপর মূল দরজা খুলে গেল আর ওর স্ত্রী অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল। শপিং ব্যাগ হাতে সে এসে লিভিং রুমে ঢুকল আর দেখল তার স্বামী ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে আর আমার হাতে ছুরি। আর মহিলার চেহারা দেখে আমি পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম কি হচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না। পিচ্চি মেয়েটার ঘুমন্ত মুখ আমার বুকে চেপে ছিল। অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। মেয়েটার গলায় ছুরি ধরে রেখে আমি খবর দেখতে থাকলাম।
অবশেষে স্ক্রিনে একজন অল্প বয়সি যুবকের চেহারা দেখা গেল। খবর পাঠক তার অপরাধের বর্ণনা দিল। কিভাবে সে প্লেন হাইজ্যাক করেছে, কিভাবে কেবিন ক্রু আর যাত্রিদের খুন করেছে। আমার মনে পড়ল ও মারা যাওয়ার আগে আমাকে কি বলেছিল, সেই সুন্দর সকালের গল্প, চারিদিক সাদা হয়ে ছিল। আমি মেয়েটার গলা থেকে ছুরি সরিয়ে নিলাম।
“একদিনে দুজনকে খুন করতে পারব না আমি।”
আমি মেয়েটাকে কোল থেকে নামিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজার দিকে যাওয়ার সময় ওকে আর ওর স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে যেতে হল আমার। ও মাথা নিচু করে ছিল, আমার দিকে তাকাল না, কিন্তু ওর স্ত্রী চেহারায় বিভ্রান্তি নিয়ে আমার দিকে তাকাল।
আমি ওর অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে ওর বিল্ডিং ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল বলে আকাশের রঙ তখন টকটকে লাল। আমি দৌড়াতে শুরু করলাম, রাস্তায় লোকজনের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগল। জানি না আমার গন্তব্য কোথায়, খালি জানি আমাকে দৌড়াতে হবে।
ওয়ারড্রব
রিয়ুজি ওর রুমের দরজাটা খুলে বলে উঠল, “অ্যাই, মিকি, শেষ পর্যন্ত তুমি আসতে পারলে! সুযোগ পেলে একটু আমার রুমে এসে তো? ফোনে তোমার সাথে যে বিষয়ে কথা বলেছিলাম তা নিয়ে আরেকটু কথা বলতে চাইছিলাম।”