লোকটার দিকে এগুতে যাব এমন সময় ছেলেটা পিস্তলটা পাশের সিটে নামিয়ে হাত পা টানটান করছিল। আমি আস্তে করে সেটা হাতে নিয়ে দেখলাম কেমন লাগে। আশ্চর্যজনকভাবে জিনিসটা বেশ ভারি ছিল। জিনিসটা শক্ত আর মনে হচ্ছিল যেন সত্যি সত্যি ধাতব কিছু একটা ধরে আছি। ভূতরা সত্যি সত্যি কোন জিনিস তুলতে পারে উপলদ্ধি করে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি পিস্তলটা নিয়ে কিছু অ্যাকশন পোজ দিলাম।
“অ্যাঁ? কি হচ্ছে এসব?” অল্প বয়সি ছেলেটা হতবুদ্ধি হয়ে বলল। হাত-পা টান টান শেষে আমার দিকে ফিরে দেখে আমি একজন নারী পুলিশের মত পোজ দিয়ে আছি। সে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
“আপনি কি আমাকে দেখতে পারছেন? আপনি ভুত দেখতে পারেন নাকি?”
সামনে বসা সবার মাথা এদিকে ঘুরে গেল। একজন সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লোকটা ওই সেলসম্যান। সে হা করে আমাকে বলল, “আপনি এখনো বেঁচে আছেন কেন?” আমি পুলিশের ভান বন্ধ করে বললাম, “আয় হায়, আমি ভেবেছিলাম আমি মরে গিয়েছি…”
“দেখে তো সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না আর যাই হোক! নিজের দিকে ভাল করে তাকান! আপনি নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছেন, বাতাসে ভাসছেন না।”
আমি নিজের পায়ের দিকে তাকালাম। ওগুলো আসলেই ভাসছে না। তারমানে সেলসম্যানের কথা অনুযায়ী আমি আসলে বেঁচে আছি। আমি নিজে ইনজেকশন পুশ করার পরও মরিনি। আমি পিস্তলটা সেলসম্যানের দিকে তাক করলাম।
“আপনি আমাকে বোকা বানিয়েছেন! ওটার মধ্যে কোন ইয়থানাসিয়া ডাগ ছিল না!”
পিস্তলের লাইন অফ ফায়ার থেকে সরার জন্য সেলসম্যান আবার সিটে বসে পড়ল। ওর সারিতে বসা বাকি লোকজন চিৎকার করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কেবিনের মধ্যে বিশাল গন্ডগোল শুরু হল।
“এক মিনিট দাঁড়ান! আমি নিজেও বুঝতে পারছি না এখানে কি হচ্ছে।” সে চিৎকার করে বলল। সিট থেকে মাথা নামিয়ে রেখেছে। এক মুহূর্ত পর সে বড় করে ঢোঁক গিলল।
“ওইটা পরোই ডাক্তারের শয়তানি! সে আমাকে বোকা বানিয়েছে আর আমাকে নকল ডাগ দিয়েছে!”
আমি ওর দিকে পিস্তল ধরে থাকলাম।
“ওর কথা ভুলে যান! আমার কি হবে এখন? আমি আমার শান্তিময় মৃত্যু পাইনি, এখন সবার সাথে আমাকেও ক্রাশ করে মরতে হবে।”
তখনো সিটটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বসে থাকা সেলসম্যান দ্রুত মাথা নাড়ল। “দাঁড়ান দাঁড়ান! শান্ত হন। আপনি কি বুঝতে পারছেন
আপনার হাতে ওটা কি ধরে আছেন?”
“বোকার মত কথা বলবেন না!”
“আপনি যদি জানেন কি ধরে আছেন তাহলে সেটা আমার দিকে তাক করে আছেন কেন? আপনার তো ওটা অন্য কারো দিকে তাক করে থাকা উচিত, তাই নয় কি?” সেলসম্যান আমার পাশে দাঁড়ানো অল্প বয়সি ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করল। “ওর দিকে পিস্তল তাক করে বলুন আত্মসমর্পণ করতে।”
আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। সে সিট থেকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“ওকে কেন আত্মসমর্পণ করতে বলব? আমি বাজি ধরে বলতে পারি ও প্লেন ক্রাশ করাতে চেয়েছিল।”
“আপনি একটা গাধা!”
অন্য যাত্রিরা ধুয়ে দিতে লাগল। আমি আরও পরিস্কারভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করলাম, আর ওদের কথার অর্থ বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম যে আমি ছেলেটার অস্ত্র দখল করেছি মানে হল প্লেন আর ক্রাশ করতে যাচ্ছে না।
পিস্তলটা সেলসম্যানের দিক থেকে সরিয়ে ছেলেটার দিকে তাক করলাম। সেলসম্যানকে দেখে মনে হল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
আমি ছেলেটাকে ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললাম। “দুঃখিত, কিছুক্ষণ আগেও আপনার পক্ষে ছিলাম আমি।”
সে স্রেফ তার মাথা ঝাঁকাল, তারদিকে যে পিস্তল তাক করা সেটা খেয়াল করার কোন নমুনা দেখাল না।
“চিন্তার কিছু নেই,” সে কাঁধ যাগ করে বলল আর ডান হাত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকালো। আমার কাছে আরেকটা পিস্তল আছে।”
কেবিনের মধ্যে টেনশন আরেক ধাপ বাড়ল। যাত্রিদের কেউ কোন টু শব্দ করল না, এক বিন্দু নড়ল না। শুধু অল্প বয়সি ছেলেটার অভিব্যক্তি দেখে মনে হল সে সবকিছুর নিয়ন্ত্রনে আছে। জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে সে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
“আমার জ্যাকেটের পকেটে আরেকটা পিস্তল আছে। আমি এখন আপনাকে গুলি করব।”
আমি ওর ডান হাত ভালভাবে দেখতে পারছিলাম না। “একদম নড়বেন না,” আমি বললাম, “হাত যেখানে আছে সেখানেই রাখুন।”
“আপনি যদি গুলি খেতে না চান তাহলে আপনাকেই প্রথমে গুলি করতে হবে, সে শান্তভাবে হাসল। তারপর আবার বলা শুরু করল। “এক শীতের রাতে আমি পড়াশুনা করছিলাম, তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি দিনের আলো ফোঁটা শুরু করেছে। তখন আমি জানালা খুলে রাতের ঠান্ডা বাতাস ঘরের ভেতর ঢুকতে দিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম নাক থেকে নিশ্বাস বের হয়ে ঠান্ডা ধোঁয়ার মত জমে যাচ্ছিল। পুরোপুরি সকাল হতেই আমি দেখতে পেলাম চারপাশ বরফে সাদা হয়ে আছে। আমার খুব খুশি লাগছিল কারন আমি আসলেই আমার পুরো মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতে পেরেছিলাম। ওই সকালটাকে আমি ভালবাসি। এখন যেহেতু আমি অনেক মানুষ মেরে ফেলেছি, আমি আর সেই সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখতে পাব না।”
বলতে বলতে সে তার ডান হাত জ্যাকেটের ভেতর থেকে বের করে আমার দিকে তাক করল। আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ট্রিগার টেনে দিলাম। হাতের তালুতে পিস্তলের রিকয়েলের ধাক্কাটা মনে হল যেন ভারি কোন বল এসে আঘাত করেছে। বাতাস স্যাঁত করে এসে আমার মুখে লাগল যেন বাতাস নিজেই ফেটে গিয়েছে। প্লেনের সবাই মাথা নিচু করে বসে পড়ল। অল্প বয়সি ছেলেটা করিডরে লুটিয়ে পড়ল। ওর ডান হাতে শুধু একটা ফাউন্টেইন পেন ধরা ছিল।
৫
আকাশের রঙ বিকেল থেকে গোধূলিতে বদলে গেল আর আমি ওর সন্তানকে আমার কোলে নিয়ে ওর বাসায় বসে টিভি দেখছিলাম। ওর সন্তান ছিল একটা মেয়ে, কিন্ডারগারটেনের বয়সি। সে বাসায় একা ছিল। অপরিচিত একজনকে দেখে ওর মধ্যে কোন আড়ষ্টভাব দেখা গেল না, সহজেই আমাকে আপন করে নিল। আমার কোলে এসে বসল। আমরা একসাথে টিভিতে খবর দেখতে লাগলাম। একটু পরই সে ঘুমিয়ে পড়ল।