ছেলেটা অস্পষ্টভাবে মাথা ঝাঁকাল।
“আপনার শান্তিময় মৃত্যু বথা যাবে না।”
“এই কথাবার্তা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে…”
আমি মাঝখান দিয়ে বলা সেলসম্যানের কথা উপেক্ষা করলাম। সিরিঞ্জে চাপ দিয়ে কয়েক ফোঁটা তরল বের হতে দিলাম। তারপর সুইটা আমার বাম বাহুতে ঢুকিয়ে চাপ দিলাম। সুঁই ঢোকায় তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা বোধ হল। সিরিঞ্জের চাপের সাথে সাথে ঠান্ডা একটা ভাব পুরো হাতে ছড়িয়ে পড়ল মনে হল।
সিরিঞ্জের ভেতর সব ফুরিয়ে গেলে আমি সুইটা বের করে খালি সিরিঞ্জটা সেলসম্যানকে ফিরিয়ে দিলাম। তারপর হাতা নামিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। “শেষ,” বললাম। গভীর অন্ধকার আমার সামনে ছড়িয়ে পড়ল।
***
“দেখুন কত দ্রুত কাজ করছে! সে এখনই নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে…”
“আমি মিথ্যা বলেছিলাম যে ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে। জিনিসটা আসলে সাথে সাথে কাজ করে। ডাক্তার তাই বলেছিল আমাকে।”
“তাহলে কেন ও কথা বললেন?”
“আমি ওকে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বেশি সময় নিতে দিতে চাইনি। মানে ধরুন যদি আপনি ধরা পড়ে যান, ব্যবসা করার জন্য তখন অনেক দেরি হয়ে যেত না?”
“আপনার কথা বুঝতে পারছি। তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আপনি এখনো আশাবাদী যে আমি ধরা পড়তে পারি?”
“ আমার সর্বোচ্চ চাওয়া সেটাই কি হওয়া স্বাভাবিক নয়? সেটা হলে আমি ব্যাঙ্কে গিয়ে ওর সব টাকা তুলে নিতে পারব। সত্যি বলতে কি আমি একদম অল্প টাকায় ডাগটা ডাক্তারের কাছ থেকে কিনেছিলাম। সুতরাং পুরোটাই লাভে লাভ। আমি হয়ত টাকাটা দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারব। কিংবা অন্তত আরেকবার আত্মহত্যার পরিকল্পনা করার আগে কিছুদিন ভাল সময় কাটাতে পারব…আহ একম আনকোরা নতুন একটা জীবন। সবকিছু বদলে ফেলে জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করার কথা কি আপনি কখনো কল্পনা করেননি?”
“না। আমার ঘণা আমার জন্য এতটাই প্রবল ছিল যে, পজেটিভ কোন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। আপনি যখন নিজেকে মৃতমানুষ হিসেবে চিন্তা করবেন তখন নতুন জীবনের কল্পনা করা অসাধ্যই। অন্তত আমার জন্য অসাধ্য। কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা সাহায্য প্রয়োজন। শুধু আপনার কাছে না, যে যে আমাকে শুনতে পারছেন তাদের সবাইকেই বলছি। আমি চাই আপনারা সবাই সিট থেকে উঠে প্লেনের সামনের দিকে যাবেন এখন। সামনের দিকে কিছু সিট খালি আছে। কিছু সিট আগে থেকেই খালি ছিল। সব মিলিয়ে অর্ধেকের মত সিট খালি আছে। আমি চাই আপনারা সবাই একসাথে বসবেন। আমার জন্য লক্ষ্য রাখা সহজ হয় তাহলে।”
“কোন সমস্যা নেই। চলুন সিট অদল বদল করা যাক। কিন্তু আমরা যদি সবাই সামনে গিয়ে বসি তাহলে প্লেনটা ভারসাম্য হারিয়ে আগেই ক্রাশ করে বসবে না?”
“আমরা এমনিতেও ক্রাশ করতেই যাচ্ছি। সুতরাং সে নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”
“ঠিক আছে। এই মহিলার কি হবে?”
“সে আর করিডরের লাশগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। বাকিরা সবাই সামনে যান। যারা এখনো জীবিত আছেন, সবাই। এইটা আমার নির্দেশ। নাকি আপনারা এমন কারো থেকে নির্দেশ পেতে চান না যে কিনা টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি?”
***
আমি মরে গিয়েছিলাম কিন্তু আবার চোখ খুললাম, তারপর ঘাড় ডলতে ডলতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তখনো সেই একই সিটে বসে আছি। মনে হচ্ছিল আমি যেন কোন প্রেতাত্মা যে এখনো প্লেনে বসে আছে।
পাশে তাকালাম কিন্তু সেলসম্যান সেখানে নেই। হাইজ্যাকারকেও দেখা গেল না। চারিদিক অন্ধকার হয়ে মারা যাওয়ার আগে শোনা ওদের কথাগুলো আমার মনে পড়ল। অল্প বয়সি ছেলেটা সবাইকে সামনে গিয়ে বসার নির্দেশ দিচ্ছিল।
আমি, যে কিনা এখন একজন ভুত, উঠে দাঁড়িয়ে সিটের উপর থেকে সামনে তাকালাম। ওই যে, প্লেনের সামনের অর্ধেক লোকজনে গাদাগাদি হয়ে আছে। সবাই আমার দিকে পেছন ফিরে আছে। প্লেনের প্রায় মাঝখান থেকে বাকি সিটগুলোসহ যেখানে আমি বসে ছিলাম, সব খালি।
পেছনের অর্ধেকে কোন জীবিত মানুষ না থাকলেও করিডোরে লাশগুলো পড়ে ছিল। প্লেনের সামনের অংশ মনে হচ্ছিল জীবিত মানুষের এলাকা। আর পেছনের অর্ধেক মৃতদের এলাকা।
সামনে একজায়গায় এন্টেনার মত খাড়া হয়ে থাকা চুল চোখে পড়ল। অল্প বয়সি ছেলেটা প্লেনের পেছনের দিকের এক সিটে বসে আছে। মৃতদের এলাকায় একমাত্র জীবিত মানুষ, এবং নিঃসঙ্গ।
কেউ কোন কথা বলছিল না। একমাত্র শব্দ ছিল ইঞ্জিনের শব্দ। আমি নিঃশব্দে ছেলেটার সিটের দিকে হেঁটে যেতে লাগলাম। করিডোরে পড়ে থাকা লাশগুলোর উপর আমার পা পড়ল। আমি সাবধানতার সাথে আমার পা ফেলছিলাম যাতে খালি কৌটাটা গড়িয়ে এলে পা দিয়ে না বসি। আমি সোজা ছেলেটার সিটের পেছনে এসে দাঁড়ালাম আর ওর মাথায় উঁচু হয়ে থাকা চুলের দিকে তাকালাম। ও গভীর মনোযোগর সাথে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল যেন কোন কিছুই দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়। আমি যেন টের পাচ্ছিলাম যে ওর মনোযোগ ওর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
আঙুলের মাথা দিয়ে আমি ছেলেটার উঁচু হয়ে থাকা চুলে স্পর্শ করলাম। উপলদ্ধি করলাম ভূত বা প্রেতাত্মা সম্পর্কে সবাই যা বলে তা সত্যি। কাউকে না জানিয়ে তারা সব কিছু স্পর্শ করতে পারে। আমার ইচ্ছা করল ভুত হয়ে কোন বুড়ো মানুষের টাক মাথায় তবলা বাজাতে। ঈগল যেভাবে শিকার খোঁজে সেভাবে আশেপাশে তাকিয়ে একজন টেকোকে খুঁজে পেলাম।