এখনই মোক্ষম সময় ছেলেটার থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়ার, কিন্তু কেউ তা করল না। ছেলেটার দুর্ভাগ্য এতটাই বিচিত্র যে কেউ ওকে আক্রমণ করার কথা ভাবতেও পারল না। ছেলেটার ভেতরের অন্ধকার অংশ তার কথাগুলোর সাথে বেরিয়ে এসেছিল, ওর কণ্ঠের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ব্যথা সবাইকে সচের মত আঘাত হানছিল।
“ঘৃণা…ঘৃণা…সবার প্রতি আমার অনুভূতি শুধু এই একটাই, সবাই…অসহ্য…আমি সবাইকে খুন করতে চাই…আমি চাই আমার মরিয়া ভাব, আমার হতাশা সবাই উপলদ্ধি করুক…দুনিয়ার সবাই…”
ছেলেটা অবশেষে মুখ থেকে হাত সরাল। মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। কিন্তু আমার মনে হল ওর চোখগুলো থেকে আগুন বের হচ্ছে।
“কিন্তু সবাইকে তো আর খুন করা সম্ভব না। তাই এই প্লেনটা হাইজ্যাক করাই আমার কাছে ভাল মনে হল। এতটুকু একজনের পক্ষে করা সম্ভব। প্লেন ক্রাশ করলে প্লেনের যাত্রিরা, টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলোতে থাকা লোকজন, সবাই মরবে কোন কারন ছাড়া। এরপর এই ভয়ংকর খবর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। এটাই আমার আশা। কিছুদিন আগে আমি অনলাইনে আমার আচার বিক্রি শুরু করেছি। বিক্রি খুব ভাল হচ্ছে। বানানোর সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। মাত্র এক বছরে আমি তিন মিলিয়ন ইয়েন আয় করে ফেলেছি।”
“সে তো আমার আয়ের চেয়েও বেশি, সেলসম্যান বলল।
“কিন্তু আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। বিষয়টা টাকার না, আমি আমার টাকা খরচ করে এই পিস্তলটা কিনেছি।”
“কার থেকে কিনেছেন?”
“পেছনের গলির এক লোকের থেকে। ভাঙা জাপানিজ বলে। সম্ভবত চাইনিজ হবে।”
আমার সন্দেহ হল ওই চাইনিজ লোক সত্যি ছিল কিনা কিন্তু কিছু বললাম না।
“আমি তার থেকে পিস্তল আর গুলি কিনি, তারপর এই প্লেনে চড়ে বসি।”
“কিন্তু পিস্তল নিয়ে প্লেনে উঠলেন কিভাবে? সিকিউরিটি ধরেনি?”
“চেকের সময় হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়েছি, হাসিমুখে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।”
“বলেন কি….”
টাকার ক্ষমতা খুবই বাজে জিনিস।
“আর সেভাবেই আমরা এখন এই পরিস্থিতিতে এসে পড়েছি।”
ছেলেটা ওর ঘড়ি দেখল।
“বাহ, সময়টা দেখুন। টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ধসে পড়তে আর মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট বাকি।”
তারপর সে সরাসরি আমার দিকে তাকাল।
“আমি এই প্লেনটা ক্রাশ করাতে যাচ্ছি। না করলে আমি জানি না কিভাবে এর থেকে মুক্তি পাব। লোকজনকে যত দুঃখ দিয়েছি…আমি সবাইকে দেখাতে চাই মৃত্যু কতখানি অর্থহীন একটা ব্যাপার।”
ছেলেটার মুখ থেকে সমস্ত অপ্রতিভ আর স্নায়বিক দুর্বলতা মুছে গিয়েছে। চোখগুলো তেজের সাথে জ্বলছিল। সে তার মৃত্যুর মিশন নিয়ে বদ্ধপরিকর। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সেলসম্যানের দিকে ঘুরলাম।
“আমি ডাগটা কিনব। আমি এই জুয়া খেলতে রাজি। আজকে হোক কালকে হোক আমি এমনিতেও শান্তিতে মরতে চাই।”
৪
“আপনি নিশ্চিত?” সেলসম্যান প্রশ্ন করলেন।
“আমি আর কিছু পরোয়া করি না,” কেবিনের চারদিকে তাকালাম আমি। করিডরের উপর লাশের স্তূপ পড়ে আছে।
“ছেলেটার চোখের দিকে যখন তাকিয়েছি তখন আমি গভীরে লুকানো কিছু একটা দেখতে পেয়েছি। আমি নিশ্চিত এই প্লেন ক্রাশ করবে আর সেই সাথে সবাই জাহান্নামের বাসিন্দা হতে যাচ্ছে।”– “কি বলছেন..? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি,” সেলসম্যান নিজেকেই নিজে বলল।
“আমি ড্রাগটা কিনব। আমার মত বদলাবে না।”
আমি লোকটাকে আমার ওয়ালেট দিলাম। আমি যে আমার সমস্ত ক্যাশ আর ব্যাংক কার্ড ওর হাতে তুলে দিয়েছি তা নিয়ে আমার কোন আফসোস হল না।
সেলসম্যান নিজের স্যুটের পকেট থেকে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা বের করল। সরু কাঁচের টিউবটার মধ্যে বর্ণহীন তরল দেখা যাচ্ছিল। আমার দৃষ্টি, হাইজ্যাকারের দৃষ্টি, করিডরের দুই পাশে বসা সমস্ত লোকের দৃষ্টি এই মুহূর্তে এই বস্তুটার উপর নিবদ্ধ।
“একজনের জীবন প্রদীপ নেভানোর জন্য এইটুকু তরল কি যথেষ্ট?” হাইজ্যাকার প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ। এটা হল মিষ্টি, কষ্টহীন মৃত্যু, সেলসম্যান সিরিঞ্জটা আমার হাতে দিতে দিতে বলল। আমি সাবধানে হাতে নিলাম যেন পড়ে না যায়। সিরিঞ্জটা মুঠোয় ধরে রাখলেও এর কোন ওজন টের পাচ্ছিলাম না। চোখের সামনে এনে বর্ণহীন তরলটার দিকে তাকালাম, কাঁচের সিরিঞ্জে কেমন যেন কৌণিকভাবে বাঁকা হয়ে আছে। সিরিঞ্জটা আশেপাশের লোকজনের দৃষ্টি কাড়ল। কেউ কেউ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ভাল করে দেখার জন্য।
“এভাবে সবাই তাকিয়ে থাকলে মৃত্যুকে বেছে নেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য।”
এ কথা শুনে কেউ কেউ কাশি দিল, কেউ কেউ অন্য দিকে তাকাল।
“আপনার হাতে নষ্ট করার মত সময় নেই। ডাগটা কাজ করার জন্য ত্রিশ মিনিটের মত সময় লাগে কিন্তু।”
আমি বাম হাতা কনুইয়ের উপর পর্যন্ত গুটিয়ে নিলাম।
“আগে কখনো নিজে নিজে ইনজেকশন দেইনি। কি করতে হবে?”
“একভাবে পুশ করলেই হল। ডাক্তার বলেছিল যেভাবেই দেয়া হোক না কেন মৃত্যু নিশ্চিত।”
সেলসম্যানের কথাগুলো শুনে আমার আস্থা বাড়ল। আঙুল দিয়ে চেপে সুঁইয়ের কাভারটা সরিয়ে ফেললাম। রুপালি রঙের লম্বা সুইটা মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এল। এক মুহূর্ত সুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে অল্প বয়সি ছেলেটার দিকে তাকালাম।
“আমি ধরে নিচ্ছি আপনি এই প্লেনটা ক্রাশ করানোর ব্যাপারে সিরিয়াস। আমি আপনার উপর ভরসা করছি যে আপনি এই প্লেনের সবাইকে ভয়ের শেষ মাথায় নিয়ে যাবেন।”