উদ্বিগ্ন আকবর পুনরায় রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ডান-পার্শ্বস্থ সেনাদের দিকে তাকালেন। তার পদাতিক বাহিনী সত্যিই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছে। বৈরাম খান, আমাদের এক্ষুনি কিছু করা উচিত। আমি কি অতিরিক্ত সেনা নিয়ে ওদের সাহায্যে এগিয়ে যাবো?
না। এতে আরো বেশি প্রাণহানি হবে-আপনিও মারা যেতে পারেন কিন্তু তেমন কোনো ফল পাওয়া যাবে না। হিমুর সেনাদের আমাদের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসতে হবে, যেখানে আমরা এখনো অনেক শক্তিশালী। তারপর বাম দিক থেকে আমরা সেনা সমাগম বাড়াতে পারি।
এই কামান গুলির মাঝে আমরা কি যথেষ্ট শক্তিশালী? আকবর প্রশ্ন করলেন।
নিশ্চয়ই সম্রাট। আমি সেনাকর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছি তারা যাতে পদাতিক তীরন্দাজদের কামানের বেষ্টনীর মধ্যে জড়ো করে। বৈরাম খান তার পার্শ্ববর্তী এক সেনা কর্তাকে হুকুম করলেন, মালবাহী গাড়িগুলিকে কামানগুলির ফাঁকে ফাঁকে জড়ো করে ফেলো সেগুলিকে আড়াল করার জন্য। অগ্রবর্তী সৈন্যদের আমাদের এখানে পিছিয়ে আসতে বলো এবং বাম দিকে যুদ্ধরত সৈনিকদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত রয়েছে তাদেরও আসতে বলো।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আকবর তখন মরিয়া হয়ে চিন্তা করছেন, তার মাথায় একটি চিন্তা এলো। বৈরাম খান, ডান পাশের যোদ্ধাদের মধ্যে যারা রক্ষা পেয়েছে তাদেরকেও আদেশ করা যায় আমাদের দিকে পালিয়ে আসতে-তারা যখন আতঙ্কিতভাবে পালানোর ভান করবে হিমু তাদেরকে অধিক উৎসাহে অনুসরণ করে আমাদের পাল্টা আক্রমণের আওতায় চলে আসতে পারে।
বৈরাম খান একটু ভেবে সম্মতি জানালেন। আপনি যুদ্ধ-শিক্ষা ভালোই আয়ত্ত করেছেন। হিমুর সেনাদের প্রচণ্ড শক্তিতে আক্রমণ করার জন্য এখনো আমাদের হাতে অব্যবহৃত অশ্বারোহী এবং হস্তীবাহিনী রয়েছে। আদম খান, একডজন সৈন্য নিয়ে এগিয়ে যাও এবং ডান পাশের সেনাকর্তাদের মধ্যে যাকেই পাও বলে তারা যেনো আতঙ্কের ভান করে আমাদের দিকে পিছিয়ে আসে।
আদম খান একদল অশ্বারোহী নিয়ে ঘোড়া ছোটালো এবং বিশৃঙ্খল যুদ্ধ ক্ষেত্রের মাঝে হারিয়ে গেলো।
দশ মিনিট পরের ঘটনা। আকবর তখনো কামান ঘেরা বৃত্তের মাঝখানে তাঁর কালো ঘোড়াটির পিঠে বসে আছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তাঁর দলের কিছু অশ্বারোহী তাঁর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের শীর্ষে রয়েছে আদম খান। যেনো ভীষণ আতঙ্কিত, সে তার হাতে থাকা সবুজ রঙের মোগল পতাকাটি ছুঁড়ে ফেললো এবং ঘোড়ার ঘাড়ের কাছে উবু হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সেটাকে ছোটাল। তাকে অনুসরণকারী অশ্বারোহীরাও তীব্র বেগে এগিয়ে আসছে। এসময় তিনি কয়েকটি বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং দেখলেন কয়েকজন অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো। কিন্তু আদম খানের কিছু হলো না দেখে তিনি আস্বস্ত হলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রের ধূলা এবং বন্দুকের ধোঁয়ার আস্তরণের উপর দিয়ে তিনি হিমুর কয়েকটি যুদ্ধ-হাতির হওদাকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। তারা আকবরের আপাতদৃষ্টিতে পলায়নরত যযাদ্ধাদের বিপুল উৎসাহে তাড়া করে আসছে।
প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীকে গোলা ছুঁড়তে বলল, আকবল বৈরাম খানের হুকুম শুনতে পেলেন। বন্দুকধারীরা, শত্রু পক্ষের হাতিগুলির মাহুতদের লক্ষ্য করে গুলি চালাও। আর তীরন্দাজেরা, সকলে একত্রে তীর ছোঁড়ার জন্য আমার হুকুমের অপেক্ষায় থাকো।
শত্রুদের দিকে তাক করা প্রতিটি কামানে অগ্নিসংযোগ করা হলো। পরপর ছয়টি প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেলো, সেই শব্দে আকবর প্রায় কালা হয়ে গেলেন এবং বারুদের ঝাঝালো গন্ধে তার প্রায় দম আটকে এলো, ধোঁয়ার কারণে স্পষ্টভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ধোয়া খানিকটা সরে গেলে তিনি দেখলেন, হিমুর পাঁচটি হাতিকে কামানের গোলা আঘাত করেছে। প্রথম হাতিটি করুণভাবে ড় তুলে আর্তনাদ করছে এবং তিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। সেটার চতুর্থ পাটি হাঁটুর নিচে রক্তাক্ত একটি খুঁটিতে পরিণত হয়েছে। বাকি তিনটি হাতি মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে আছে। তাঁদের মধ্যে একটি হঠাৎ মৃত্যুযন্ত্রণায় সেটার পিঠে থাকা হাওদার সৈন্যসহ গড়ান দেয়ায় সেনারা সেটার দেহের নিচে পিষ্ট হয়ে গেলো।
পঞ্চম হাতিটির পেটে সৃষ্টি হওয়া গভীর ক্ষত দিয়ে সেটার নীলচে-ধূসর বর্ণের নাড়িভুড়ি প্রায় বেরিয়ে এসেছে। আকবর দেখলেন সেটার হাওদাটি প্রায় মাটি ছুঁয়েছে, একজন সৈন্য মাটিতে পড়ে গেলো, কিন্তু কিছু অক্ষত তীরন্দাজ তখনো সেটার মধ্যে রয়ে গেছে। হাতিটি পালাচ্ছে এবং সৈন্যসহ হাওদাটি সেটার পেছনে মাটিতে ছেচড়ে যাচ্ছে। আতঙ্কিত হাতিটি আক্রমণ করতে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসতে থাকা অন্য হাতিগুলির সামনে পড়ে গেলো। একটি বিশাল হাতির সঙ্গে আহত হাতিটির প্রচন্ড সংঘর্ষ হলো এবং আহত হাতিটি সেটার দাঁতে আটকানো খঞ্জরের ফলায় বিদ্ধ হলো এবং তারা উভয়েই মাটিতে আছড়ে পড়লো। এগিয়ে আসা আরেকটি হাতি আহত হাতিটির ছেচড়ে নেয়া হওদার উপর হোঁচট খেয়ে ভূপাতিত হলো, ফলে সেটার হাওদায় থাকা সৈন্যরা ছাতু হয়ে গেলো। হিমুর হাতিগুলির আক্রমণের গতি শ্লথ হয়ে এলো, তারা তাদের ভূপাতিত স্বজাতীয়দের এড়িয়ে যেতে সচেষ্ট হলো।