আকবরের ভালো ঘুম হয়নি। গৌরব ও বিজয়ের বিক্ষিপ্ত কল্পনা এবং দুঃশ্চিন্তা মিলেমিশে তাঁকে কেবলই সতর্ক করেছে বারবার, যেনো তাকে বলেছে- সাবধান! নিজের এবং তোমার পূর্বপুরুষের অমর্যাদা করোনা। শুধু শুধু শুয়ে না থেকে দুঘন্টা আগেই তিনি উঠে পড়েছেন। এখন তিনি পিতার বক্ষবর্ম এবং তলোয়ারে সুসজ্জিত। মাথায় পড়েছেন ঘাড়ের কাছে ধাতব পাত যুক্ত শিয়োস্ত্রাণ (হেলমেট)। তাঁর পাশে রয়েছেন বৈরাম খান এবং চওড়া কাঁধের অধিকারী তারদি বেগ, তারাও অস্ত্রে সজ্জিত এবং শিরোম্রাণ পরিহিত। আকবর অনেক কষ্টে বৈরাম খানকে রাজি করিয়েছেন তারদি বেগকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দিয়ে আরেকবার তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেয়ার জন্য।
দেড়ঘন্টা পর একটি অগ্রবর্তী দলকে অনুসরণ করে আকবর তার দুধ-ভাই আদম খানকে পাশে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁর অবস্থান প্রায় একমাইল চওড়া অগ্রসরমান বাহিনীর মাঝামাঝি স্থানে। তার ঘোড়াটিও যেনো তাদেরই মতো যুদ্ধ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। বৈরাম খান তাদের থেকে অল্প দূরে ঘোড়া ছোটাচ্ছেন। তিনি আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী আশ্বারোহী বাহিনী এবং অগ্রবর্তী দলটি যেনো কোনোক্রমেই ষাঁড়-টানা গোলন্দাজ বাহিনী এবং হস্তী বাহিনীর কাছ থেকে বেশি দূরে সরে না যায়। আর পায়ে হেঁটে অগ্রসরমান তীরন্দাজ বাহিনীকেও তারা যেনো কাছাকাছি রাখে।
মোঘাচ্ছন্ন আকাশ নিয়ে ভোর হলো, নিচু মেঘগুলি বায়ুতাড়িত হয়ে ছুটে চলেছে। কিন্তু আকবর যখন উপরদিকে তাকালেন তখন মেঘগুলির মাঝে ফাঁক সৃষ্টি হয়ে সূর্য উঁকি দিলো, সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি তাঁর বর্মের উপর পড়ে ঝলসে উঠলো। নিজের ঊর্ধ্বমুখী মুখের উপর তিনি আচমকা উষ্ণতা অনুভব করলেন, তিনি বৈরাম খানকে লক্ষ্য করে বললেন, এটা আমাদের সৌভাগ্যসূচক আরেকটি দৈব সংকেত, তাই না? এই সংবাদটি আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিন। উদিত সূর্য আজ একমাত্র আমার উপরই আলো ছড়াচ্ছে। আর হিমু কালো মেঘ দ্বারা আচ্ছাদিত। জয় আমাদেরই হবে। পরবর্তীতে আরো বিজয় আমরা অর্জন করবো। আমাদের সাম্রাজ্য চন্দ্রগ্রহণের মতো অন্য সব রাজ্যকে আচ্ছাদিত করবে এবং তার চমৎকারিত্বে সকলের চোখ ঝলসে যাবে।
বৈরাম খান আকবরের বক্তব্যকে সমর্থন জানাতে যখন তার দিকে ফিরলেন, সেই মুহূর্তে আকবর তার বাবার তলোয়ারটি কোষমুক্ত করে মাথার উপর ঘুরালেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢুলিদের যুদ্ধ-ঢাকের আওয়াজ জোরাল হলো এবং শিঙ্গার আর্তনাদে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। জয় আমাদেরই হবে, আকবরের এই চিৎকার তার সমান্তরাল সকল যোদ্ধার মুখে উচ্চ স্বরে প্রতিধ্বনিত হলো।
কিন্তু সম্মুখ থেকে এর উত্তর ভেসে এলো, হিমুর যোদ্ধাদের সাহসী চিৎকার। হিমু, হিমু, হিমুপাদীশাহ! রেকাবে (ঘোড়ার পাদানী) ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আকবর দেখলেন তার সৈন্যদলের বাহিত সবুজ পতাকা ছাড়িয়ে প্রায় একমাইল দূরত্বে হিমুর হাতিগুলির বর্ম সূর্যের আলোয় ঝলসে উঠছে। তিনি হিমুর কৌশল বুঝতে পারলেন। হিমু তার যোদ্ধাদের আশেপাশের ছোট ছোট পাহাড় গুলিতে স্থাপন করেছে, বহু বছর আগে আকবরের পিতামহ বাবর একই কৌশলে তাঁর মহান বিজয় অর্জন করেছিলেন। আকবরের মতো হিমুও সম্মুখ আক্রমণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
আকবর বিস্ফোরণ উনুখ আগ্নেয়গিরির মতো উত্তেজনা অনুভব করলেন। তিনি তাঁর উঁচু কালো ঘোড়াটির পেটে লাথি মেরে সম্মুখে অবস্থিত যোদ্ধাদের মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে এগিয়ে গেলেন, আদম খান এবং তার ঘাবড়ে যাওয়া দেহরক্ষীরা প্রাণপণে তাঁকে অনুসরণ করলো।
সম্রাট, আমাদের ডান-পার্শ্বস্থ যোদ্ধারা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে, এক সেনাকর্তা আধঘন্টা পর আকবরের কাছে এগিয়ে এসে বললো। তার মুখমণ্ডল ধূলা আর ঘামে মাখামাখি হয়ে গেছে এবং তার শিরোস্ত্রাণটি খোয়া গেছে। তার সাদা ঘোড়াটি জোড়ালো শ্বাস ফেলছিলো এবং সেটার পশ্চাদদেশে(পাছা) তলোয়ারের আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। বৈরাম খান ইতোমধ্যে সম্মুখ সেনাদের অতিক্রম করা আকবরের উন্মত্ত গতি প্রতিরোধ করেছেন, এখন তিনি ও আদম খান তার পাশাপাশি আগাচ্ছেন। তারা তিনজন ছোট আকারের একডজন ব্রোঞ্জের কামানের বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করছে। কামানগুলি দাগার প্রস্তুতি চলছে। যেখানে সংঘর্ষ চলছে তার থেকে প্রায় একশ গজ পেছনে রয়েছেন তারা।
কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে আকবরের সম্মুখে বৈরাম খান সেনা কর্তাটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তারদি বেগের ভূমিকা কি আশাব্যঞ্জক?
অবশ্যই জনাব, কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে সে জবাব দিলো। যুদ্ধের কেন্দ্রস্থলে তার পতাকা এখনো সমুন্নত। তারদি বেগ হিমুর সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ হাতিগুলির সামনে পড়ে গেছেন। সেগুলি তারদি বেগের যোদ্ধাদের প্রায় পিষ্ট করে ঢুকে গেছে। আমাদের বন্দুকধারীদের ছোঁড়া গুলি হাতিগুলির ইস্পাতের মস্তক-আবরণ ভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। হাতিবাহিনীর আক্রমণকে অনুসরণ করে হিমুর পদাতিক সৈন্যরাও আক্রমণ করেছে। তাঁদের অনেকে পুরানো লোদী বংশীয় পতাকা বহন করছে। সর্বশেষ আমি দেখি তারদি বেগ প্রবল প্রতাপে শত্ৰু যোদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে গেছেন। কিন্তু ডান দিকে অবস্থিত আমাদের অশ্বারোহী সেনারা পিছু হটছে, কেউ কেউ তাদের সহযোদ্ধাদের ত্যাগ করে অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছে। যারা প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে তাদেরকে ঘিরে ফেলে হত্যা করছে শত্রুরা।