অল্পসময় পরেই বোঝা গেলো সেটা আহমেদ খানই, বৈরাম খানের পরামর্শে আকবর তাকে হিমুর অবস্থান ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে অধিক নিশ্চিত হওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে পাঠিয়েছিলেন তিন দিন আগে। প্রায় পনেরো মিনিট পর সে তাঁদের কাছে পৌঁছালো এবং আকবরের সম্মুখে বিনীতভাবে অবনত হলো।
সোজা হউন, আহমেদ খান, কি সংবাদ এনেছেন বলুন?
কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা হিমু এবং তার মূল সেনাবহিনীকে খুঁজে পেয়েছি। তারা পানিপথে শিবির স্থাপন করেছে, এখান থেকে মাত্র বার মাইল উত্তর দিকে। পানিপথ নামটি আকবরের পরিচিত এবং এরসঙ্গে তার খানিকটা গৌরবও জড়িয়ে আছে। ত্রিশ বছর আগে তাঁর পিতামহ বাবর দিল্লীর লোদী বংশীয় সুলতান ইব্রাহিমকে এই পানিপথের যুদ্ধেই পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। এবার আকবরের পালা পানিপথের আরেকটি যুদ্ধে মোগল বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার। বয়সে তরুণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে বংশীয় ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য।
হিমুর বাহিনীতে কতোজন সৈন্য আছে আহমেদ খান? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
আমরা ধারণা করছি প্রায় একলক্ষ বিশ হাজার, তাঁদের অর্ধেক অশ্বারোহী এবং উত্তম মানের। আর প্রায় পাঁচশত যুদ্ধ-হাতি রয়েছে।
আমরা যা ভেবেছিলাম সেটাই সত্যি হলো, আমাদের তুলনায় তার বিশ হাজার সৈন্য বেশি আছে। তাঁর কামান এবং বন্দুকের সংখ্যা কতো? আমরা যা ভেবে ছিলাম তার তুলনায় কম সংখ্যক কামান আছে ওদের, সর্বমোট ত্রিশটি হতে পারে, সেগুলির বেশিরভাগই ছোট আকারের। দূর থেকে যতোটা বুঝতে পেরেছি তার পদাতিক সৈন্যদের হাতে বন্দুকের পরিবর্তে তীর-ধনুক রয়েছে। তবে অল্পসংখ্যক বন্দুকধারী তার দলে রয়েছে।
বন্দুকের দিক থেকে আমরা ওদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, কি বলেন বৈরাম খান? আকবর তার প্রধান সেনাপতির দিকে ফিরলেন। পানিপথে যুদ্ধ না করার মতো আমাদের তেমন কোনো যুক্তি নেই, আছে কি? সেটি আমাদের সৈন্যদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনা একটি স্থান। সেখানে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে আমাদের যোদ্ধারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস পাবে, আমাদের সৈন্যসংখ্যা যদিও তুলনামূলকভাবে কম।
বৈরাম খান তাঁর অনুগ্রহভাজন তরুণ সম্রাটের উৎসাহ দেখে মৃদু হাসলেন। জ্বী সম্রাট, সেটি নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধ করার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান। আমরা এই বন্ধ্যা সমভূমির উপর দিয়ে গুপ্ত আক্রমণের আশঙ্কা ছাড়াই দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারবো।
আকবর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই আহমেদ খান বলে উঠলেন, মহামান্য সম্রাট, আপনি পানিপথকে মোগলদের বিজয়ের জন্য সৌভাগ্যজনক বলছেন। সেটা সত্যি-কিন্তু হিমুর জন্য এর কোনো তাৎপর্য নেই। হিমুর শিবিরে ব্যবসা করেছে এমন একজন সওদাগরকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি এবং তার কাছে একটি গল্প শুনেছি। সে দাবি করেছে যে হিমুর একান্ত ব্যক্তিগত এক সেবকের কাছে সে এই গল্পটি শুনেছে। কিন্তু এই গল্পটি হিমুর দলের সকলেই জানে। কারণ পরবর্তীতে আমাদের হাতে বন্দী আরেকজন সৈনিক একই গল্পের পুনরাবৃত্তি করেছে।
গল্পটি কি? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।
সেটা হলো বেশ কিছু রাত আগে হিমুর হস্তিদলের একটি বিশাল হাতি বজ্রপাতের আঘাতে মারা যায়। আস্তাবলের অন্য হাতিগুলি সামান্য আহতও হয়নি। পরদিন সকালে হিমু যখন সংবাদটি জানলো তখন সে স্বীকার করলো যে, একই রাতে সে একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সে দেখেছে সে তার হাতির পিঠ থেকে একটি খরস্রোতা নদীতে পড়ে গিয়েছে। সে যখন ডুবে যাচ্ছিলো তখন একজন মোগল যোদ্ধা তাকে টেনে তীরে তুলে। তারপর তাকে শিকল দিয়ে বাঁধে এবং তার গলায় একটি দড়ি পেচিয়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। হিমু তার অনুসারীদের কাছে স্বপ্নটি ব্যাখ্যা করে এভাবে-সে বলে তার বংশে এমন ঐতিহ্য রয়েছে যে তারা স্বপ্নে যা দেখে তাদের বাস্তব জীবনে তার বিপরীত ঘটনা ঘটে। অতএব শীঘ্রই সে মোগলদের তাঁদের হাতির উপরের সুরক্ষিত আসন থেকে ভূমিতে ধরাশায়ী করবে এবং আমরা সকলে তার কাছে বন্দীত্ব বরণ করবো। যদিও পরবর্তীতে পরিষ্কার বোঝা গেছে সে ভীষণ চিন্তিত এবং সে তার হিন্দু দেব-দেবীর প্রতি মুক্তহস্তে উৎসর্গ প্রদান করছে।
এটা নিঃসন্দেহে একটি দৈব সংকেত, আকবর ভাবলেন। এসময় বৈরাম খান বলে উঠলেন, এই গুজব যদি সত্যি নাও হয়, এর প্রচার হিমুর শিবিরের যোদ্ধাদের মনোবল কমিয়ে দেবে। এই জন্যই আমি মনে করি এখনই আমাদের পানিপথের দিকে অগ্রসর হওয়া।
*
দুইদিন পরের ঘটনা। ভোর হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রন্ধন কাজের জন্য জ্বালা আগুনের উজ্জ্বল কমলা রঙের শিখায় ভোরের ধূসর আধো-অন্ধকার অপসারিত হচ্ছিলো। আকবরের লোকেরা তড়িঘড়ি করে খাবার খেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। কিছুটা বিচলিত মনে আঙ্গুলের সাহায্যে তারা তাদের তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করছে এবং বারংবার ঘোড়ার পিঠে বাঁধা জিন যথেষ্ট শক্তভাবে এটে আছে কিনা দেখছে। সেইসঙ্গে বিড়বিড় করে আসন্ন যুদ্ধে সাফল্য লাভের জন্য তাদের স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছে। অন্যদিকে যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ছোট কামানগুলিকে চব্বিশটি ষাঁড়ের সঙ্গে জোতা হয়েছে যাতে সেগুলি সৈন্যদের সঙ্গে একই গতিতে অগ্রসর হতে পারে। অন্যদিকে হস্তী বাহিনীর মাহুতেরা হাতিগুলিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছিলো। সেগুলিকে ইস্পাতের বর্ম পড়ান হচ্ছিলো এবং তাঁদের দাঁতে বাঁকা খঞ্জর বাঁধা হচ্ছিলো। এই সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পরেই তাদের পিঠে হাওদা বসান হবে যার উপর সৈন্যরা অবস্থান নেবে। হেকিমরা তাদের তাবুতে প্রয়োজনীয় মলম এবং ছোট ছোট শিশিতে ব্যাথা উপষমকারী ওপিয়াম ভরে সৈন্যদের জন্য প্রস্তুত রাখছিলো। সেই সঙ্গে মারাত্মক জখমের চিকিৎসার জন্য করাতো এবং ছ্যাকা দেয়ার দণ্ডও গুছাচ্ছিলো।