আকবর বক্তব্য শেষ করে আসন গ্রহণ করার সময় এক মুহূর্ত বৈরাম খানকে লক্ষ্য করলেন, তিনি প্রায় দুর্বোধ্য মস্তক হেলানের মাধ্যমে আকবরের কঠোর বক্তব্যের প্রতি তাঁর সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। অন্যান্য উপদেষ্টা এবং সেনাপতিরা তখন দাঁড়িয়ে আছেন এবং হঠাৎ তাদের সম্মিলিত কণ্ঠের উচ্চ শব্দে তাবু প্রকম্পিত হলো, সকলে একই বাক্য উচ্চারণ করছেন: মির্জা আকবর! মির্জা আকবর! তিনি প্রথমে আশ্বস্ত হলেন এবং তারপর গর্ববোধ করলেন। তারা কেবল তাঁকে তৈমুরের বংশধর একজন আমিরজাদা হিসেবেই মেনে নিলো না- বরং সম্রাট হিসেবে তাঁর প্রথম যুদ্ধাভিযানে তাঁকে অনুসরণ করার ইচ্ছাও প্রকাশ করলো। তিনি কিশোর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বক্তব্যকে তারা গুরুত্ব প্রদান করেছে, ফলপ্রসূ নির্দেশনা দিতে পেরে তিনিও তৃপ্তিবোধ করছেন।
একঘন্টা পর আকবর মহিলাদের জন্য নির্ধারিত অন্দর মহলে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তাঁদের শয়ন এবং গোসলের তাবুগুলি সোনার পাতে মোড়া উঁচু কাঠের তৈরি ঝাঁঝরি দিয়ে সুরক্ষিত যেগুলি ষাঁড়ের চামড়ার ফিতা দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা। একটিমাত্র প্রবেশ পথ উত্তম ভাবে সুরক্ষিত। তিনি যখন মায়ের তাবুতে প্রবেশ করলেন চন্দনের মিষ্টি গন্ধ তাঁর নাকে ভেসে এলো।
হামিদা রেশমের ফুল সজ্জিত একটি কোলবালিশে শুয়ে ছিলেন এবং তাঁর পরিচারিকা জয়নাব তার লম্বা কালো চুল আচড়ে দিচ্ছিলো। আরেক দিকে ফুফু গুলবদন একগ্রচিত্তে একটি বীণার তারে সুর মূর্ঘনায় মগ্ন ছিলেন। হামিদার বিপরীত দিকে আকবরের দুধমা মাহাম আঙ্গা একটি কামিজের উপর নশা সূচিকর্ম করছিলেন। মোগল রীতি অনুযায়ী রাজপুত্র এবং দুধমার সম্পর্ক আজীবন অবিচ্ছিন্ন থাকে। একইভাবে আকবরের তুলনায় কয়েক মাসের বড় মাহাম এর নিজ পুত্র আদম খান তার দুধ-ভাই এর মর্যাদা প্রাপ্ত এবং এই সম্পর্ক আপন ভাইয়ের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।
আকবরকে দেখে এই তিনজন মহিলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তার মা হামিদার বয়স তখনো ত্রিশ পেরোয়নি এবং তাঁর শরীর হালকা-পাতলা। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আকবরকে জড়িয়ে ধরলেন। গুলবদন বীণা রেখে মৃদু হাসলেন। মাহাম আঙ্গাও তাঁকে উষ্ণ আলিঙ্গন করার জন্য এগিয়ে এলেন।
আকবর তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী তিন মহিলাকে একত্রে দেখে খুশি হলেন যাদের তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন মনে করেন। আমি যুদ্ধ সংক্রান্ত সভা থেকে সরাসরি তোমাদের এখানে এসেছি। হিমুর অগ্রবর্তী সৈন্যরা দিল্লী দখল করে নিয়েছে কিন্তু তারা বেশিদিন দখলে থাকতে পারবে না। আগামীকাল আমার নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনী হিমু ও তার মূল সৈন্যদল এর গতিরোধ করবে তারা দিল্লীতে পৌঁছানোর আগেই। আমরা হিমুকে পরাজিত করে আমাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করবো।
বাছা আমার, আবেগসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন হামিদা, আমি সর্বদাই জানতাম, এমনকি যখন তুমি আমার পেটে ছিলে, যে একদিন তুমি এক মহান যোদ্ধা এবং নেতা হবে। আমার সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হতে যাচ্ছে দেখে আমার হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ। আমি তোমাকে কিছু জিনিস দিতে চাই। তিনি জয়নাবকে ফিসফিস করে কিছু বললেন, সে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলো। যখন ফিরে এলো দেখা গেলো তার হাতে সবুজ মখমলে জড়ানো কিছু রয়েছে যা সে হামিদার পায়ের কাছে শতরঞ্জির উপর রাখলো। হামিদা নিচু হয়ে মখমলের আচ্ছাদন সরিয়ে দিলেন, আকবর দেখলেন সেখানে তাঁর পিতার সোনালী বক্ষবর্ম (ব্রেস্টপ্লেট) এবং ঈগলাকৃতির হাতল বিশিষ্ট তলোয়ার-আলমগীর, যার খাপে নীলা পাথরের অলঙ্করণ রয়েছে।
বর্ম এবং তলোয়ার প্রত্যক্ষ করে আকবরের মনের পর্দায় এতেঠ স্পষ্টভাবে তাঁর পিতার অবয়ব ভেসে উঠলো যে তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন যাতে তার মা তার চোখের অশ্রু দেখতে না পান। হামিদা এবং মাহাম আঙ্গা তাঁর বক্ষে বর্ম পরিয়ে দিলেন। হুমায়ূন লম্বা এবং পেশীবহুল ছিলেন কিন্তু আকবরও ইতোমধ্যে সেই গড়ন লাভ করেছেন। বক্ষবর্মটি তাঁর শরীরে ভালোই মানিয়ে গেলো। এবারে হামিদা তাঁর দিকে আলমগীর এগিয়ে দিলেন। আকবর ধীরে তলোয়ারটি খাপমুক্ত করলেন এবং শূন্যে সেটা কয়েকবার চালালেন। সেটার ওজন এবং ভারসম্য তিনি সন্তুষ্টিবোধ করলেন।
তোমার প্রস্তুতির জন্য আমি এতোদিন অপেক্ষা করছিলাম, হামিদা বললেন, যেনো তিনি আকবরের মনের কথা বুঝতে পারছেন। এখন তুমি প্রস্তুত। আগামীকাল যখন তুমি রওনা হবে, আমি মাতাসুলভ দুশ্চিন্তা অনুভব করবো ঠিকই কিন্তু সেই সঙ্গে একজন সম্রাজ্ঞীর গর্বও। আল্লাহ্ যেনো তোমার সহায় হোন আমার বাছা।
.
০২. একটি কাটা মাথা
মধ্যাহ্ন শেষে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে দিগন্ত ঝিকমিক করছিলো যখন দাঁড়িয়ে থাকা আকবর বিচলিত মনে এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর দিলেন। দিল্লীর উত্তর-পশ্চিম দিকের এক বৈচিত্রহীন ছোট ছোট পাহাড় বেষ্ঠিত এলাকার সমভূমিতে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন তপ্ত বায়ুমণ্ডলের স্বচ্ছ পর্দা ভেদ করে প্রায় পঞ্চাশ জন সৈন্যের একদল অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে। তাদের আগমন লক্ষ্য করতে করতে তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৈরাম খানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওদের সম্মুখে ওটা আহমেদ খান তাই না?
আমি নিশ্চিত নই। আপনার তরুণ চোখগুলি আমার থেকে ভালো, কিন্তু ওদের একজন যে পতাকাটি বহন করছে সেটা নিঃসন্দেহে আমাদেরই সবুজ রঙ চিহ্নিত মোগল পতাকা।