বৈরাম খানের মুখ রাগে কঠিন হয়ে উঠলো। দিল্লী থেকে পালিয়ে এসে তুমি প্রতিটি বিদ্রোহী এবং গোত্রপতিদের কাছে এমন ইঙ্গিত পাঠিয়েছে যে তারা আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধা করবে না। আমি তোমার সঙ্গে বিশ হাজার সৈন্যের একটি দল রেখে এসেছিলাম….
সেটা যথেষ্ট ছিলো না।
তাহলে তোমার উচিত ছিলো আমাকে বার্তা পাঠানো এবং রাজধানী রক্ষা করা যতোক্ষণ পর্যন্ত না আমি অতিরিক্ত সেনা পাঠাতাম।
তারদি বেগের চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো এবং তার ডান হাতের আঙ্গুল গুলো কোমরবন্ধনীতে গুঁজে রাখা রত্নখচিত খাপ যুক্ত খঞ্জরটির (ড্যাগার বা ছোরা) হাতলের দিকে এগিয়ে গেলো। বৈরাম খান আপনি আমাকে বহু বছর ধরে চেনেন এবং আমরা পাশাপাশি যুদ্ধ করেছি ও রক্ত ঝরিয়েছি। আপনি কি আমার বিশ্বস্ততার প্রতি সন্দেহ পোষণ করছেন?
তোমার আচরণের জন্য ভবিষ্যতে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে, তারদি বেগ। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো তোমার হারানো রাজধানী কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়। আমাদের উচিত… একজন বাদামি দাড়ি বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তাবুতে ঢুকতে দেখে বৈরাম খান থেমে গেলেন। আহমেদ খান, তুমি নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছো দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। কি খবর এনেছে আমাদের বলো?
আকবর সর্বদাই আহমেদ খানের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন, সে তার পিতা হুমায়ূনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে অন্যতম ছিলো। হুমায়ূন তাকে আগ্রার প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু হিমুর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর বৈরাম খান তাকে ডেকে পাঠান এবং তার সাবেক পদ-প্রধানদূত ও গোপন তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তার ধূলিমলিন অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সদ্য শিবিরে পৌঁছেছে।
হিমু তার মূল সেনাবাহিনীর দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যদি তার বর্তমান গতি বজায় থাকে তাহলে সে আনুমানিক দুই সপ্তাহের মধ্যে রাজধানীতে পৌঁছে যাবে। হিমুর দলের সঙ্গে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা একদল সৈন্যকে আমার সেনারা পাকড়াও করে, তাদের কাছ থেকেই এই তথ্য উদ্ধার করা গেছে। তারা আরো জানায় রাজধানীতে পৌঁছে হিমু নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করছে। ইতোমধ্যে সে নিজে পাদশাহ উপাধি ধারণ করেছে এবং নিজ নামে মুদ্রা (টাকা) তৈরির আদেশ প্রদান করেছে। আরো জানা গেছে, এই মর্মে বক্তব্য প্রদান করছে যে হিন্দুস্তানে মোগলরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, সেই মোগলদের উত্তরসূরি এক বালক এখন শাসন ক্ষমতার অধিকারী এবং এই সাম্রাজ্যের শিকড় এতো নাজুক যে খুব সহজেই এর মূল উৎপাটন করা যাবে।
আহমেদ খানের বক্তব্যে মন্ত্রিসভার মধ্যে যেনো আচমকা প্রাণসঞ্চার হলো। আকবরের মনে হলো সকলে পরস্পরের দিকে ভীত দৃষ্টি বিনিময় করলো। আমাদের এখনই আঘাত করা প্রয়োজন-হিমু দিল্লীতে পৌঁছে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার আগেই, বৈরাম খান বললেন। তাড়াতাড়ি অগ্রসর হলে সে দিল্লীতে পৌঁছানোর আগেই আমরা তার নাগাল পাবো।
কিন্তু সেটা খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে, হেরাত থেকে আগত এক সেনাপতি আপত্তি জানালো। আমরা যদি পরাজিত হই তাহলে আমাদের সবকিছু হারাতে হবে। আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে আমাদের আরো একটু সময় নেয়া উচিত…।
বাজে কথা। এমন শক্তিশালী অবস্থানে থেকে হিমু আলোচনার প্রস্তাবকে পাত্তা দিতে যাবে কেনো? বললেন মোহাম্মদ বেগ, তিনি বারাকসানি এলাকার একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা। আমি বৈরাম খানের সঙ্গে একমত।
তোমরা সকলে ভুল করছো, মুখ খুললেন আলী গুল, যে একজন তাজাক। আমাদের সামনে একটাই পথ খোলা রয়েছে-আমদের লাহোরে যাওয়া উচিত, সে স্থানটি এখনো মোগল নিয়ন্ত্রণে আছে এবং সেখানে আমরা শক্তিসঞ্চয় করতে পারি। তারপর যখন আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী হবো, তখন শত্রুদের বিতাড়িত করতে পারবো।
কেউ তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না, আকবর ভাবলেন-যখন ক্রুদ্ধ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সভাসদরা তার চারপাশে শোরগোল তুললো। বৈরাম খান এসব বরদাশত করতে পারছিলেন না এবং একাগ্রভাবে আকবরের দিকে তাকিয়েছিলেন। আকবর বুঝতে পারছিলেন তিনি তার পরবর্তী পদক্ষেপ বিবেচনা করছেন। তিনি এব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলেন যে বৈরাম খানের প্রস্তাবই সঠিক-আক্রমণ করাই সেই মুহূর্তে শত্রুদের প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ উপায়। তাঁর পিতাও পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারকালে অনেক ক্ষেত্রে দেরির কারণে শত্রুরা শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। সেই মুহূর্তে আকবর মনস্থির করে ফেললেন। তাঁর বাবার মতো নিজেকে তিনি হিন্দুস্তান থেকে বিতাড়িত হতে দিবেন না। হিন্দুস্তান শাসন করা মোগলদের নিয়তি, তারচেয়েও বড় সত্য এটা তার নিয়তি এবং তিনি এখানে টিকে থাকার চেষ্টাই অব্যাহত রাখবেন।
আকবর নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ালেন, সকলের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হলো। যথেষ্ট হয়েছে! এই সাম্রাজ্য ত্যাগ করে পালানোর চিন্তা করার স্পর্ধা তোমরা কোথায় পেলে? তিনি উচ্চস্বরে বললেন। তোমাদের কোনো অধিকার নেই অত্মসমর্পণ করার। এখানে আমিই ন্যায়সঙ্গত। শাসক এবং সম্রাট। আমার দায়িত্ব-আমাদের দায়িত্ব-নতুন ভূ-খন্ড জয় করা এবং যেসব ভূ-খন্ড আমাদের পূর্বপুরুষ আমাদের জন্য জয় করে গেছেন সেগুলিকে শত্রুর কাছে সমর্পণ করে পালিয়ে যাওয়া নয়। এখনই আমাদের উচিত হিমুকে আক্রমণ করা এবং হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া তরমুজের মতো তাকে ধ্বংস করা। আমি নিজে সৈন্যদের নেতৃত্ব দেবো।