দিল্লীর সীমান্তে বৈরাম খানের অনুগত আরো সৈন্য তাঁদের সঙ্গে মিলিত হলো এবং নিরাপত্তা প্রদান করে তাঁদের শহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী একটি শিবিরে নিয়ে এলো। এক সপ্তাহ পর বৈরাম খান তার মূল সেনাবাহিনীসহ তাঁদের সঙ্গে মিলিত হলেন এবং আকবরকে তার ইটের সিংহাসনে বসিয়ে দিল্লীর সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দিলেন। তারপর ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে উপযুক্ত নিরাপত্তা প্রদান করে বৈরাম খান আকবরকে দিল্লীতে ফিরিয়ে আনেন এবং শুক্রবারের জুম্মার নামাজের সময় তাঁর নামে খুদ্বা পাঠ করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে নতুন সম্রাট হিসেবে আকবরের পরিচিতি সমগ্র বিশ্বের কাছে ঘোষিত হয়। তখনো যাদের নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বোনার সময় ছিলো তাদের বিরুদ্ধে এটি ছিলো। কৌশলগত পদক্ষেপ। এই ঘোষণার পর সকল মোগল নেতারা আকবরের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলো।
এর ফলে আভ্যন্তরীণ শত্রুদের মোকাবেলা করা হলো, কিন্তু সাম্রাজ্যের দূরবর্তী রাজ্য গুলিতে আকবরের অভিষেক সংবাদের প্রভাব ততোটা জোড়াল ভাবে পড়লো না। পারতপক্ষে হিন্দুস্তানের উপর মোগলদের প্রভাব তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যেসব রাজা এবং জায়গিরদারগণ অল্প সময় আগে আকবরের পিতা হুমায়ুনের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করেছিলো তারা স্বাধীন হতে চাচ্ছিলো এবং সাম্রাজ্যের বাইরের শত্রুরা সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ চালাচ্ছিলো। কিন্তু তাদের সবার উপরে সবচেয়ে বিপদজনক হুমকি স্বরূপ দেখা দিলো হিমু। আগে তাকে শত্রু হিসেবে ততোটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সে ছিলো ছোটখাট গড়নের মিষ্টভাষী একটি লোক। তবে তার চেহারাটি কুৎসিত এবং সে নিচু বংশোদ্ভূত এক অজ্ঞাত চরিত্র, যে বলতে গেলে প্রায় শূন্য থেকে একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গঠন করে ফেলতে সক্ষম হয় এবং মোগল শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। ইতোপূর্বে আকবর হিমুর ব্যাপারে বিন্দু মাত্র মাথা ঘামাননি কিন্তু এখন তিনি ভাবছেন বাস্তবে সে কেমন ধরনের মানুষ এবং কোনো মন্ত্রবলে সে তার যোদ্ধাদের দলে টানলো। তাঁর এ সাফল্যের পিছনে কি রয়েছে?
*
আকবরের শিবির হিসেবে গড়ে তোলা বিশাল তাবুশহরের প্রাণকেন্দ্রে তিনি প্রবেশ করছিলেন। বিশালদেহী হাতিটির পিঠে নিরাপদ উচ্চতায় অবস্থিত হাওদা (হাতির পিঠে নির্মিত আসন) থেকে তিনি সামনে তাকালেন, কেন্দ্রস্থলে তার নিজের তাবুটি দেখলেন-সেটি উজ্জ্বল রক্তিম বর্ণের যা সম্রাটের প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে-সেটির পাশে প্রায় একই দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণীয়তায় তৈরি বৈরাম খানের তাবুটি অবস্থিত। প্রধান সেনাপতি তাঁর জন্য তাবুর বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন, তাকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো আকবরের সেখানে পৌঁছানোর জন্য তিনি কতোটা অস্থির হয়ে ছিলেন।
আকবর হাতির পিঠ থেকে নামতে না নামতেই বৈরাম খান মুখ খুললেন। সম্রাট, আপনি খবরটা শুনেছেন-হিমুর সৈন্যরা দিল্লী দখল করে নিয়েছে। ইতোমধ্যেই আপনার তাবুতে যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কার্যক্রম শুরু করেছে এবং এখন আমাদের কি করণীয় সে সম্পর্কে বাকবিতণ্ডা চলছে। আকবর বৈরাম খানকে অনুসরণ করে তাবুতে ঢুকে দেখলেন অন্যান্য সেনাপতি এবং পরামর্শদাতারা তার বসার জন্য নির্ধারিত সবুজ মখমলে আচ্ছাদিত সোনার পাত মোড়া একটি টুলের চারপাশে পুরু লাল-নীল বর্ণের শতরঞ্জিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে। আকবর আসন গ্রহণ করার পর সকলে দাঁড়িয়ে তাকে সংক্ষিপ্ত অভিবাদন জানালো, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন পুনরায় আসন গ্রহণ করার সময় তাঁদের নজর কতোটা সমীহের সঙ্গে তাঁর পাশে দাঁড়ানো বৈরাম খান কে প্রত্যক্ষ করলো। তারদি বেগকে তলব করো, সে তার বক্তব্য সম্রাটকে পুনরায় অবহিত করুক, বৈরাম খান আদেশ দিলেন। কয়েক মুহূর্ত পর দিল্লীর দায়িত্বে নিয়োজিত মোগল প্রশাসক সেখানে উপস্থিত হলো। আকবর তারদি বেগকে চিনতেন এবং পছন্দও করতেন। সে ছিলো উত্তর কবুলের পাহাড়ী এলাকায় জন্মলাভ করা এক অসীম আত্মবিশ্বাসী যোদ্ধা, পেশীবহুল বিশাল দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভরাট কণ্ঠের অধিকারী। তাঁর চোখজোড়া সর্বদা হাস্যকরভাবে মিটমিট করে কিন্তু এই মুহূর্তে সেগুলি রোদে-পোড়া, শুষ্ক এবং বিষণ্ণ রূপ ধারণ করেছে।
তারদি বেগ, ম্রাট এবং মন্ত্রীসভার সম্মুখে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করো। বৈরাম খানের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত ঠাণ্ডা শোনালো। বলো কীভাবে তুমি একজন যবক্ষার (নাইট্রিক এ্যাসিড) বিক্রেতা এবং তার অনুগত বিদ্রোহীদের কাছে সাম্রাজ্যের রাজধানীকে আত্মসমর্পণ করে পালিয়ে এলে।
তারা কোনো মামুলী বিদ্রোহী নয়, বরং অত্যন্ত শক্তিশালী, উত্তমভাবে অস্ত্রসজ্জিত এক সেনাবাহিনী। হিমু ছোট বংশোদ্ভূত হতে পারে কিন্তু যে কেউ তাকে ভাড়া করেছে তার জন্যই সে সফলভাবে যুদ্ধ জয় করেছে বহুবার। কিন্তু এখন সে আর ভাড়াটে সৈন্য নয়, সে এখন নিজের স্বার্থে লড়ছে। সম্রাটের পিতামহ যে পুরানো লোদী সাম্রাজ্যকে বিতাড়িত করেছিলেন হিমু তাদের অনুসারীদের আমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, বহু সৎ এবং গর্বিত ব্যক্তিও তাকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। আমাদের গুপ্তচরেরা খবর দিয়েছে একটি বিশাল অগ্রবর্তী বাহিনী পশ্চিমের সমভূমি থেকে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, আর হিমুর মূলবাহিনীর আরো বিশাল, তাঁদের রয়েছে তিনশত যুদ্ধ-হাতি এবং তাদের অবস্থান দিনের (প্রতিদিন তারা যততা দূর অগ্রসর হচ্ছে) হিসাবে বেশি দূরেও নয়। এই অবস্থায় রাজধানী ত্যাগ না করলে আমরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতাম।