উদয় সিং টের পাবে তার উপর আমার কর্তৃত্ব আছে কি নেই। আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা আমাদের সামরিক প্রস্তুতি শেষ করে উদয় সিংকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য অভিযান চালাবো। কিন্তু আজ আপনারা উপভোগ করুন আপনাদের জন্য যে আমোদের ব্যবস্থা আমি করেছি! উপস্থিত সকলে আকবরের সমর্থনে উল্লাসধ্বনি করে উঠলো, আকবর তাঁর পান্নাখচিত পান পাত্রটি উঁচিয়ে ধরে বললেন, মোগলদের জয় হোক।
*
আট সপ্তাহ পরের ঘটনা। আকবর ও আহমেদ খান আগ্রার দূর্গের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সূর্যের তীব্র আলোর কারণে আকবরের চোখ গুলি কুচকে ছোট হয়ে আছে। তিনি সেখান থেকে যমুনা নদী পারের শুকনো মাটিতে প্রশিক্ষণরত একদল সৈন্যকে দেখছিলেন। সৈন্যরা সারিবদ্ধভাবে একজনের পিছনে আরেকজন ঘোড়ার পিঠে বসে ছিলো। তাদের সামনে মাটিতে একসারিতে পাঁচ গজের ব্যবধানে বিশটি বর্শা গাঁথা ছিলো। এক একজন সৈনিক গেঁথে রাখা বর্শাগুলির মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আকাবাঁকা পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো। শেষ বর্শাটির কাছে পৌঁছে তারা নিজেদের ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিলো এবং সেখান থেকে প্রায় দশ গজ দূরে স্থাপিত একটি খড়ের মানবাকৃতিতে তাদের বর্শা ছুঁড়ে মারছিলো। প্রত্যেকে লক্ষভেদে সফল হচ্ছিলো।
চমৎকার, আকবর বলে উঠলেন। সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু করতে আর কতোদিন লাগতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আর এক মাস-এর আগেও হতে পারে। যদিও আমাদের গোলন্দাজদের নতুন নকশার বড় আকারের কামানে গোলার ভরার প্রশিক্ষণের জন্য আরো কিছু দিন সময় প্রয়োজন। এই নতুন ধরনের অধিক শক্ত নল বিশিষ্ট কামান গুলি তুর্কী কারিগরেরা আমাদের ঢালাই কারখানায় প্রস্তুত করেছে। এছাড়া লাহোরের দক্ষ বন্দুক কারিগরদের কাছে ফরমায়েশ করা অতিরিক্ত গাদাবন্দুক গুলিও, এসে পৌঁছায়নি। নিশানা দূরত্ব বাড়াতে এই নতুন বন্দুকগুলিতে বর্তমান বন্দুকের তুলনায় দ্বিগুণ বারুদ ভরা যাবে-একথা আমাকে জানানো হয়েছে এবং সেগুলি হাতে বিস্ফোরিত হওয়ার ভয়ও নেই। ওগুলি যখন আমাদের হাতে এসে পৌঁছাবে তখন আমাদের আশেপাশে হাজার মাইলের মধ্যে অমাদের মতো শক্তিশালী আর কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। এমনকি আমরা পারস্যের শাহ্দের চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর বলে বিবেচিত হবে।
যমুনা পারে প্রশিক্ষণরত একজন সৈন্য যখন মাটিতে গেঁথে রাখা বর্শাগুলি তুলে নিল তখন সমগ্র দলটি নতুন করে সম্ভব হলো। এখন তারা সারিবদ্ধভাবে মাটিতে সাজানো মাটির পাত্র ছুটন্ত ঘোড়া থেকে বর্শায় গেঁথে তুলে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এবারে তাদের প্রচেষ্টা আগের মতো ভালো হলোনা। একজন ঘোড়সওয়ার লক্ষচ্যুত হয়ে তার বর্শাটি মাটিতে গেঁথে ফেলায় ডিগবাজী খেয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টে পড়লো এবং পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা পেলো।
আকবর হাসলেন। তার নিজের দেহেও আঘাতের অনেক চিহ্ন আছে। তিনি এখন নিয়মিত প্রশিক্ষণ করছিলেন। গাদাবন্দুক, তলোয়ার এবং যুদ্ধকুঠার নিয়ে তিনি অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন যততক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলিকে তাঁর নিজের শরীরের অংশ মনে হচ্ছিলো। তিনি তাঁর সেনাকর্তাদের সঙ্গে কুস্তিও লড়ছিলেন। প্রথমে তারা আকবরকে সমীহ করার কারণে তাঁকে মাটিতে আছড়ে ফেলতে ইতস্তত করছিলো। কিন্তু আকবরের দক্ষতা, গতি এবং কৌশলের চাপে পড়ে শীঘ্রই তারা সব ব্যবধান ভুলে গেলো।
দ্রুত গাঢ়লাল বর্ণ ধারণ করতে থাকা আকাশের দিকে একপলক তাকালেন আকবর। আর মাত্র আধ ঘন্টা পরেই চারদিক অন্ধকার হয়ে আসবে। আদম খান আমি নদী তীরের ঐ সৈন্যগুলির সঙ্গে পোলো খেলতে চাই। কিন্তু এখনতো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
একটু ধৈর্য্য ধরুন, তারপর বুঝতে পারবেন।
আধ ঘন্টা পর, সাধারণ জোব্বা এবং পাজামা পড়ে, একটি ছোট আকারের কিন্তু পেশীবহুল বাদামি রঙের ঘোড়ায় চড়ে আকবর দূর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি কুচকাওয়াজের মাঠ পার হয়ে নদী তীরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। পোলো খেলার সরঞ্জাম নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করছে পরিচারকরা। নদীর তীরে পৌঁছে আকবর ঘোড়ার পাঁজরে মৃদু গুতো দিয়ে সেটাকে অর্ধবল্পিত (দ্রুততম গতির তুলনায় কিছুটা কম গতি) গতিতে ছুটালেন এবং কিছুটা দূরে থাকা ঘোড়সওয়ারদের কাছে উপস্থিত হলেন। সম্রাটকে দেখে তারা ঘোড়া থেকে নেমে অভিবাদন জানানোর উদ্যোগ নিলো।
না। তোমরা জিনের উপরেই থাক। আমি একটা পরীক্ষা চালাতে চাই, আকবর বললেন।
আধারের কালচে নীল ছায়া যখন নদীটিকে ঢেকে দিলো তখন আকবর তাঁর পরিচারকদের আদেশ দিলেন তাঁর অভিনব পোলো খেলার আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য। তারা উপস্থিত লোকগুলির মাঝে পোলো খেলার লাঠি বিতরণ করলো, গোলের লাঠিগুলি গেড়ে তার পাশে মশাল পুতে দিলো এবং অবশেষে কয়লা জ্বালা পায়াওয়ালা ধাতব ঝুড়ির মধ্যে পোলো খেলার কাঠের বলটি রাখল। বলটি রাখার প্রায় সাথে সাথেই সেটা ধিকি ধিকি করে জ্বলতে লাগলো, কিন্তু চার পাঁচ মিনিট পরেও সম্পূর্ণরূপে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো না। আকবর হাসলেন। তাহলে তৈমুরের গল্পটি সত্যি! যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা প্রদানের পর বেশ কিছুদিন সন্ধ্যায় আকবর তাঁর কোর্চিকে(ব্যক্তিগত সেবক) তৈমুরের বীরত্বপূর্ণ অভিযানের লিখিত উপাখ্যান পড়ে শোনাতে বলেন। উদ্দেশ্য, যদি কোনো ব্যতিক্রমী বিষয় তিনি তার মহান পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারেন। সেখানে উল্লেখ ছিলো তৈমুর দৈবক্রমে আবিষ্কার করেন যে, সোমরাজ গাছের শক্ত কাঠে আগুন দেয়া হলে তা ধিকি ধিকি করে কয়েক ঘন্টা ধরে জ্বলে। তখন তৈমুর তার যোদ্ধাদের আদেশ দেন সোমরাজ গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি জ্বলন্ত বল নিয়ে সারারাত পোলো খেলার জন্য। এভাবে তিনি তাদেরকে যুদ্ধের জন্য সবল করে তুলতেন। এই কাহিনী শোনার পর থেকে নিজেই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য আকবর উদগ্রীব ছিলেন।