ওজন পর্ব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহামূল্যবান উপহার সমূহ বিতরণ করার কাজ শুরু হলো। গৃহস্থালির রসদ সংরক্ষক জওহর এর সহায়তায় আকবর হিসাব করেছেন প্রত্যেকে কতোটা সম্পদ পাবে এবং সে আকবরের নির্দেশে তা খাতায় লিপিবদ্ধ করেছে। আকবর দেখতে লাগলেন জওহর একে একে সকলের নাম ধরে ডাকছে এবং তার সভাসদ, সেনাপতি এবং মিত্ররা তাদের জন্য নির্ধারিত অর্থ, রত্ন এবং রেশমীকাপড় নিতে এগিয়ে আসছে। তাদের সন্তানদের জন্যেও উপহার ছিলো: সোনালী পতায় পেচানো খুবানি (বাদাম), খেলনা মোগল সৈন্য-অশ্বারোহী, তীরন্দাজ এবং বন্দুকধারী এবং কানে রূপার দুল পড়া মেয়ে পুতুল, গলার হার, বালা ইত্যাদি। দূরবর্তী প্রদেশগুলির রাজ্যপালদের পাঠানোর জন্যেও আকবর কিছু ধন-রত্ন সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেন। এছাড়া সম্রাজ্যের শহরগুলিতে অবস্থিত শস্যভাণ্ডার গুলিতে পাঠানোর জন্যেও তিনি শস্য, চাল এবং তেল সংরক্ষণ করতে বলেন যাতে সাধারণ প্রজারাও তাঁর উদারতার ভাগ পায়। সেই দিন রাতে বিশাল উঠানের গোলাপজল প্রবাহিত ঝর্নাকে ঘিরে জমে উঠে রাজকীয় ভোজ সভা। সেখানে মখমল ঢাকা বেদির উপর সোনার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আকবর আমন্ত্রিতদের সঙ্গে ভোজে অংশ নেন। তাঁর দক্ষ বাবুর্চিদের তৈরি উপাদেয় খাবারে টেবিল ভরপুর। আস্ত ভেড়ার ঝলসানো মাংস, শুকনো ফল ও বাদামের উপর সাজানো রান্না করা হাঁস এবং তিতির জাতীয় পাখির মাংস, জাফরান ও উপাদেয় মসলা যুক্ত মাখনের আখনি, দৈ এবং মসলায় পাকানো মুরগি প্রভৃতি। প্রাচুর্যের আরেক মাত্রা যোগ করার জন্য আকবর নির্দেশ দেন থালায় রাখা বিনিয়ানির ঢিবির চারদিকে রত্ন ছড়িয়ে রাখার জন্য। ঘি দিয়ে পাকানো বিরিয়ানিতে কিসমিস, আলুবোখারা, খোবানি, পেস্তাবাদাম প্রভৃতি যোগ করা হয়েছে। কাবুল থেকে বিশেষ ভাবে বরফসহ মোড়কে বেঁধে তাজা আঙ্গুর এবং তরমুজও আনা হয়েছে।
আকবর অপেক্ষা করলেন যততক্ষণ পর্যন্ত না বেশিরভাগ অতিথি মুখ মুছে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এখন সময় হয়েছে তাঁদের কাছে তাঁর পরিকল্পনার কথা বলার। তাঁদের উজ্জ্বল পরিতৃপ্ত মুখগুলি যখন আকবরের দিকে ফিরলো তখন তিনি এমন আত্মবিশ্বাস অনুভব করলেন যে তারা যেকোনো স্থানে তাকে অনুসরণ করতে রাজি হবে।
এখন আমি আপনাদেরকে আমার ইচ্ছার কথা জানাতে চাই। আমার পিতামহ বাবর হিন্দুস্তান জয় করার পর চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। অকালমৃত্যুর কারণে তিনি তাঁর রাজ্যের সীমা বাড়াতে পারেননি এবং একই কারণে আমার পিতাও একাজে অগ্রগতি সাধন করতে পারেননি। কিন্তু আমি তরুণ এবং আমার পূর্বপুরুষের যোদ্ধারক্ত আমার শিরায় সবলভাবে স্পন্দনরত। এর কাছ থেকে আমি নির্দেশনা পাই যে একটি টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই আমার নিয়তি। এমন একটি সাম্রাজ্য যাকে কেবল একটি যুদ্ধের সাহায্যে পরাজিত করা সম্ভব হবে না বরং অনাগত শতাব্দীগুলিতে বিস্ময়কর মর্যাদায় মাথা উঁচু করে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় রাজ্য জয় করা। আজ আমি আমাদের সাম্রাজ্যের কিছু ধন-সম্পদ আপনাদের প্রদান করেছি, কিন্তু আগামী বছর গুলিতে আমি আপনাদের যে সোনা ও মহিমা উপহার দেবো তার তুলনায় এই পরিমাণ খুবই সামান্য-আপনাদের সহায়তায় আমি যখন মোগল সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করবে তখন আপনারা সেটা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। আমার রাজত্ব বিস্তৃত হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, সাগর থেকে সাগরে। দক্ষিণ দিকে তা দাক্ষিণাত্যের বিশাল মালভূমি ছাড়িয়ে গোলকোন্দার হীরক খনি পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং সেই উৎকৃষ্ট হীরা আমার সিংহাসনে এবং আপনাদের স্ত্রী ও রক্ষিতাঁদের দেহে দীপ্তি ছড়াবে। এসব অলস দম্ভোক্তি নয়। এখানে আপনাদের সকলের সামনে আমি শপথ করছি নতুন ভূখণ্ড পরাভূত করার কেবল আমাদের সীমান্ত বর্তী ছোট ছোট গোত্র গুলি নয় যারা মনে করে আমাদের বিরোধীতা করে তারা পার পেয়ে যাবে, বরং সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাজ্য গুলিও। যদি তারা তাদের গর্বিত মস্তক মোগল আধিপত্যের কাছে নত করে তাহলে তারা আমাদের ক্ষমা, সম্মান এবং মহত্ত্বের অংশিদার হতে পারবে। কিন্তু যদি তারা প্রতিরোধ করে তাহলে আমার সেনাবাহিনী তাদের যোদ্ধাদের হাড় চূর্ণ করে ধূলায় মিশিয়ে দেবে এবং তাঁদের প্রাসাদ ও দূর্গকে ধ্বংসতূপে পরিণত করবে।
তাই আমি আহ্বান করছি, আপনারা সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন! প্রথমে যে আমাদের ক্ষমতার তেজ অনুভব করবে সে হলো মেওয়ার এর রানা উদয় সিং, রানা সাঙ্গার পুত্র। রানা সাঙ্গাকে আমার পিতামহ বাবর চল্লিশ বছর আগে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। মেওয়ার এর রানারা দাবি করে তারা রাজপুতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্যান্য রাজপুত রাজারা বহু দিন আগে থেকেই আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে আসছে। কিন্তু উদয় সিং এখন আমাদের প্রতি প্রকাশ্যে বিদ্রোহী আচরণ প্রদর্শন করছে। তার যোদ্ধারা কয়েকদিন আগে মোগল বণিকদের গুজরাট উপকূলগামী একটি কাফেলায় আক্রমণ করে। আমি উদয় সিং এর কাছে এরজন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করলে সে আমাকে একটি অপমানজনক বার্তা পাঠায়: তুমি উত্তরের অসভ্য ঘোড়া চোরদের বংশধর। কিন্তু আমি ভগবান রামের উত্তরসূরি এবং সেই সূত্রে চন্দ্র, সূর্য এবং আগুনের সন্তান। কাজেই আমার উপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব নেই।