দেহে সোনার কারুকাজখচিত সবুজ রঙের শক্ত আলখাল্লা, গলায় বাঁকা আকৃতির পান্না শোভিত মালা এবং মাথায় আলো বিচ্ছুরণকারী হীরকখচিত পাগড়ি পড়ে আকবর ঢাকের গম্ভীর শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাঁড়িপাল্লাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। জ্বেলে রাখা মশালের আলোতে দাঁড়িপাল্লার পাশে রাখা অনেকগুলি ঢাকনা খোলা সিন্দুক থেকে রাশি রাশি মণিমাণিক্য জ্বল জ্বল করছে। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আকবর সন্তুষ্ট হলেন। এছাড়াও মঞ্চের উপর বহু সোনা ও রূপার তৈরি শিকল কুণ্ডলী করে রাখা হয়েছে-যেনো এক একটি সাপ। সেইসাথে সোনা-রূপার কারুকাজ করা অনেকগুলি থলে ইচ্ছাকৃত ভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রায় উপচে ভরা হয়েছে সম্রাটের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য। মণিমাণিক্যের পাশে পিতলের তালায় থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন সুস্বাদু মশলা। এর পাশে জেড পাথরের পাত্রে রয়েছে দুপ্রাপ্য সুগন্ধী। আরো সাজানো রয়েছে কারুকার্যখচিত সূক্ষ্ম রেশমী কাপড়ের গাঁট।
সেখানে আরেকটি জিনিস ছিলো-বিশটি বিশাল লৌহখন্ড। আকবর লক্ষ্য করলেন অনেকগুলি কৌতূহলী দৃষ্টি সেগুলি পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি যখন মঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িপাল্লার দিকে এগিয়ে গেলেন ঢাকের ছন্দবদ্ধ দামামা থেমে গেলো এবং শিঙ্গার একক ধ্বনি চারদিক প্রকম্পিত করলো। শিঙ্গার সংকেত লাভের সঙ্গে সঙ্গে পরিচারকগণ লৌহখণ্ড গুলি তুলে নিলো এবং দাঁড়িপাল্লার বিশাল একটি থালায় সেগুলি ভরতে লাগলো। লৌহখণ্ডের চাপে পাল্লার থালাটি মেঝে স্পর্শ করলো। আদম খানকে হত্যার পর দুই বছর পার হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ের অধিকাংশ তিনি এই ভাবনায় ব্যয় করেছেন যে, কেনো তিনি আদম খানের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি পূর্বেই অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং কীভাবে তিনি তার সভাসদগণের মধ্যে নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের বিকাশ দমন করতে পারবেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন একটা কারণে তিনি আদম খানকে সন্দেহ করতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন, সেটা হলো আদম খান ও মাহাম আঙ্গা বাল্যকাল থেকে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত থাকার জন্য। বৈরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর কাছাকাছি এমন পর্যায়ে আর কেউ নেই। ভবিষ্যতে আর কাউকে তিনি এমন অবস্থানে আসতে দিবেন না এবং কাউকে এতোটা বিশ্বাসও করবেন না। তাকে তার নিজের অনুভূতির উপর নির্ভর করতে হবে। যদিও আদম খান ও মাহাম আঙ্গার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা আংশিকভাবে তাঁদের ষড়যন্ত্রের প্রতি তাঁর অন্ধত্বের কারণ কিন্তু তিনি নিজেও কম আত্মতুষ্ট ছিলেন না, নিজ ক্ষমতা ও মর্যাদা নিয়ে তিনি এততাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি ভাবতে পারেননি কেউ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে।
ভবিষ্যতে এ ধরনের গোলযোগ এড়ানোর জন্য একটি বুদ্ধি হঠাৎ করেই তার মাথায় আসে। একদিন তাঁর সেবক আকবরকে তাঁর পিতামহের স্মৃতি সম্বলিত বই পড়ে শোনাচ্ছিলো। বাবরের বিচক্ষণ মতামত গুলির মধ্যে দুটি বিষয় আকবরের মনোযোগ কাড়ে: যুদ্ধ এবং লুষ্ঠিত সম্পদ ব্যক্তিকে সৎ রাখে এবং তোমার অনুসারীদের প্রতি সদয় হও। তারা যদি অনুভব করে, যে অন্য কারো তুলনায় তোমার কাছ থেকেই তারা বেশি লাভবান হবে তাহলে তারা তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সফল হয়ে থাকেন তিনি হবেন বাবার এবং তাঁর কাছ থেকেই আকবরের শিক্ষা নেয়া উচিত। এ কারণেই তিনি সভাসদ, সেনাপতি এবং মিত্রদের আজ এখানে জমায়েত করেছেন তিনি তাদের বলবেন শীঘ্রই তিনি বিজয় অভিযান শুরু করতে চান যার ফলে রাজকীয় কোষাগারগুলি সোনা এবং রত্নে উপচে পড়বে এবং সেই অবশ্যম্ভাবী পুরষ্কারের সামান্য স্বাদ তিনি আজ তাদের প্রদান করতে চান। আকবর সংক্ষিপ্তভাবে হাসলেন তারপর হাত তুলে সবাইকে নীরব হতে বললেন।
পূর্বে আমার পিতা যেমনটা করেছেন অনুরূপভাবে হিন্দুস্তানের শাসকদের প্রথা অনুসারে আমি জনসম্মুখে মূল্যবান ধন-রত্নের সঙ্গে নিজেকে ওজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বছরে দুবার এই অনুষ্ঠান পালন করবো-একবার আমার চন্দ্র বছরের জন্মদিনে, যেটা আজকের দিন এবং আমার সৌর বছরের জন্মদিনে। ওজন করার পর ধন-সম্পদ গুলি আমন্ত্রিতদের মাঝে বিতরণ করা হবে। আজ এই কার্যক্রম আপনারা প্রত্যক্ষ করবেন। আপনাদের প্রতি আমার বিশেষ শুভেচ্ছা প্রদর্শনের জন্য আজকের এই প্রথম অনুষ্ঠানে আমি আপনাদেরকে আমার দেহের ওজনের তুলনায় বেশি ধন-সম্পদ প্রদান করবো। এই লৌহ খন্ডগুলির ওজন আমার ওজনের তুলনায় দ্বিগুণ। আকবর একমুহূর্ত সময় দিলেন তার কথাগুলি উপস্থিত সকলকে অনুধাবন করার জন্য। তারপর তিনি আসনসিঁড়ি হয়ে দাঁড়িপাল্লার খালি থালাটিতে বসলেন।
আকবরের পরিচারকগণ সঙ্গে সঙ্গে অপর থালাটি ভরা শুরু করলো এবং প্রথমে তারা সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান গুলি তুলতে লাগলো। দশ সিন্দুক রত্ন উঁচু করে থালাটিতে জড়ো করার পর আকবরের বসে থাকা থালাটি ধীরে মেঝে থেকে উপরে উঠতে লাগলো। চারদিকে ভীষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে এবং আকবর অনুভব করলেন সকলের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ, এবং প্রত্যেকে মনেমনে হিসাব করছে তাদের ভাগে লুটের মালের কতোটা অংশ আসবে। মোগল বংশ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, তিনি চিন্তা করলেন, তখন রত্নগুলি সরিয়ে থালায় সোনা এবং রূপার শিকল ভরা হতে লাগলো এবং তারপর স্বর্ণমুদ্রার পোটলা। আগের সময়ে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত লুটের মাল পুরষ্কার হিসাবে প্রদান করা হতো, তখনো হয়তো শত্রুদের মৃতদেহ গুলিতে উষ্ণতা বজায় থাকতো। প্রত্যেক গোত্রপতি তার ভাগের লুষ্ঠিত সম্পদের উপর নিজের ঢাল রাখতে তারপর তা টেনে নিয়ে যেতো নিজের দলের লোকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু সেটা ছিলো এমন সময় যখন মোগলদের কোনো স্থায়ী আবাস ছিলো না। সেদিন এখন আর নেই। তিনি এখন হিন্দুস্তানের সম্রাট এবং তার উচিত অনুগামীদের অধিক পুরষ্কার প্রদান করা। সেটা কেবল যুদ্ধ অভিযানে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নয় বরং সফলভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্যেও।