মাহামকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। তোমার দুধমা হিসেবে সে তার পবিত্র বন্ধনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। হামিদা রুঢ় কণ্ঠে বললেন।
না। তার ছেলের মৃত্যুই তার জন্য যথেষ্ট শাস্তি। তাছাড়া আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয় যে তিনি শৈশবে আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।
আমার মনে হয় মাহামকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তুমি সঠিক কাজ করেছে, গুলবদন কোমল স্বরে বললেন। যে আসল হুমকি ছিলো তার উপযুক্ত ব্যবস্থা তুমি করেছে এবং একজন মহিলার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা নিপ্রয়োজন। হিন্দুস্তানের এক পরাজিত শাসকের মা যখন তোমার পিতামহকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতে চেয়েছিলো, তিনি তাকে ক্ষমা করেছিলেন এবং সে জন্য অধিক শ্রদ্ধাও অর্জন করেছিলেন। তিনি হামিদার দিকে ফিরলেন। আমি বুঝতে পারছি তোমার অনুভূতি কেমন, কিন্তু তুমি যখন তোমার ক্রোধ এবং আঘাতকে অতিক্রম করে যাবে তখন তুমি বুঝতে পারবে যে আমি ঠিক কথাই বলছি।
হয়তো, হামিদা আস্তে করে বললেন। কিন্তু গুলবদন, আমার মতো তুমিও জানো অতিরিক্ত ক্ষমা প্রদর্শনের পরিণতি কি। তোমার ভাই এবং আমার স্বামী বার বার তাদের ক্ষমা করেছেন যাদের তার হত্যা করা উচিত ছিলো এবং এর ফলে আমরা অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছি।
হুমায়ূন তাই করেছেন যা তিনি সঠিক বলে বিশ্বাস করেছেন এবং সেজন্য নিশ্চিতভাবেই তিনি নিজেকে অধিক মহৎ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
মা এবং ফুফুর কথাবার্তা আকবর তেমন মনোযোগের সঙ্গে আর শুনছিলেন না। আদম খানের বিশ্বাসঘাতকতা তার প্রতি আকবরের ভালোবাসাকে সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারেনি। তিনি যদি তাকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারতেন তাহলে হয়তো তাকে গুরুতর অপরাধগুলি সংঘটন করা থেকে বিরত করতে পারতেন। আদম খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করার কোনো উপায় কি তার জানা ছিলো?
হঠাৎ আকবর অনুভব করলেন তার মা ও ফুফু কথা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার বোঝা উচিত ছিলো কি ঘটতে যাচ্ছে, তিনি বললেন। বৈরাম খানের ব্যাপারে মাহাম আঙ্গার পরামর্শ গ্রহণ করা আমার উচিত হয়নি বরং নিজের কাছেই প্রশ্ন করা উচিত ছিলো এতে তার কি লাভ ছিলো। শায়জাদা যখন তার বোনের অপহরণকারী হিসেবে আদম খানের নাম উল্লেখ করলো তখন আমার উচিত ছিলো আদম খানকে আরো কঠোরভাবে প্রশ্ন করা। এমনকি আমি এই মর্মে একটি সতর্কবাণী পেয়েছিলাম যে বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে- কেউ একটি চিরকুট আমার কক্ষে রেখে গিয়েছিলো।
আমি জানি। আমার পরিচারকই তা করেছিলো। সে একটু আগে আমাকে এ কথা বলেছে। বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রফিক অনেক কিছু দেখতে ও শুনতে পায় যা অন্যরা বুঝতে পারে না। সে আড়িপেতে শুনে যে আদম খান বৈরাম খানের মৃত্যুর জন্য আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করছে এবং ধারণা করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। যদিও তার কাছে কোনো প্রমাণ ছিলো না তবুও সে তোমাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলো। নিজের জামার হাতা ছিঁড়ে সে চিরকুট বানায় কারণ কাগজ যোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না এবং সুযোগ বুঝে তোমার ঘরে রেখে আসে। আকবর, রফিক ভয় পাচ্ছে তার সন্দেহের কথা সাহস করে সরাসরি তোমাকে না বলায় তুমি হয়তো তাকে শাস্তি দেবে।
না। আমি তার কাছে দ্বিগুণ ঋণী। একটু আগে আমি যখন হেরেমে নিরস্ত্র ছিলাম তখন সে আমাকে একটি তলোয়ার দিয়েছিলো। তাকে জানিও আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তার বিশ্বস্ততার উপযুক্ত পুরষ্কার আমি তাকে দেবো। যে অঘটন ঘটে গেছে তার সকল দায় আমার। রফিকের সতর্কবাণী সত্ত্বেও আমি আদম খানকে তেমন ভাবে চাপ দেইনি। আমি বোকার মতো কাজ করেছি। আমি আদম খান এবং মাহাম আঙ্গাকে ভালোবাসতাম এবং তারা সেই ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে আমার চারপাশের সকলের উদ্দেশ্যের বিষয়ে আমাকে সন্দেহ ও প্রশ্ন করতে হবে- এমনকি যারা আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী তাঁদের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য হবে। একজন সম্রাটের ভূমিকা অত্যন্ত নিঃসঙ্গ এই বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। একজন শাসকের কারো উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত নয়।
তুমি যদি এই দুঃখ জনক বাস্তবতা থেকে কিছু শিখে থাক তাহলে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে, হামিদা বললেন, তার চেহারা বিষণ্ণ। আজ থেকে বহু বছর পরে তুমি যখন আজকের দিনটির কথা মনে করবে তখন তুমি উপলব্ধি করবে এটা ছিলো সেই সময় যখন তুমি কৈশোরকে অতিক্রম করে বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষে এবং একজন ম্রাটে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীতে আমাদের মর্যাদা যাই হোক না কেনো, সকলের জীবনই বহু তিক্ত উপাদানে পূর্ণ। আজ তুমি এর কিছুটা স্বাদ পেয়েছে, দোয়া করি ভবিষ্যতে তুমি আরো বলিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
২.১ সূর্য, চাঁদ এবং আগুনের সন্তান
দ্বিতীয় খণ্ড – সূর্য, চাঁদ এবং আগুনের সন্তান
০৬. সম্রাটের বিজয় অভিযান
এই মাত্র সূর্য ডুবেছে, আকাশে তখন হালকা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়েছে, যে অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ হতে চলেছে তার উপযুক্ত পটভূমিকা যেনো প্রকৃতি স্বয়ং রচনা করেছে, আকবর ভাবলেন। আগ্রার দূর্গের সম্মুখবর্তী কুচকাওয়াজের মাঠ বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত পারসিক শতরঞ্জিতে ঢেকে ফেলা হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো একটি ফুল বাগান। মাঠের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে সোনার পাত মোড়া কাঠের রেলিং-এর পিছনে আকবরের সেনাপতি এবং উচ্চপদস্থ সভাসদগণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর সম্মুখে তৃতীয় দলটিতে উপস্থিত ছিলেন সেই সব শাসক যারা আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। মধ্যবর্তী স্থানে সবুজ রেশমের শামিয়ানার নিচে মার্বেল পাথরের মঞ্চের উপর একটি বিশাল সোনার দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হয়েছে। এর সোনার থালা দুটির এক একটি পাঁচ ফুট ব্যাপ্তি বিশিষ্ট এবং চারদিক হীরকাকার গোলাপ-সিলিকা এবং মুক্তা দ্বারা আবৃত। আট ফুট উঁচু ওক কাঠের কাঠামো থেকে মোটা শিকলে বাঁধা অবস্থায় পাল্লার থালাগুলি ঝুলছে।