মাহাম আঙ্গা ধীরে তার মাথাটি দুপাশে নাড়ছিলেন এবং ফোঁপান ও বিলাপের মধ্যবর্তী একটি বেদনাদায়ক শব্দ করছিলেন। আমাকে বলল সে এখনো বেঁচে আছে, অবশেষে তিনি কান্না জড়িত স্বরে বলে উঠলেন।
আকবর তার কাছে এগিয়ে গেলেন। আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। আমার নির্দেশে তাকে মাথা নিচের দিকে দিয়ে প্রাচীরের উপর থেকে নিচে ফেলা হয়। আমার কাছে তার অপরাধের যে কেবল চাক্ষুশ প্রমাণ ছিলো তাই নয়, দম্ভের সঙ্গে সে তার অন্যান্য অপরাধের কথাও স্বীকার করেছে-আমাকে পাঠানো মেয়ে গুলিকে সে আক্রোশ এবং ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে অপহরণ ও হত্যা করে। তার চেয়েও জঘন্য বিষয় হলো সে বিদ্রূপ করে আমাকে বলে বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ড সেই পরিচালনা করেছে। এমন ঔদ্ধত্য এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি ছিলো…তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া ছাড়া আমি আর কি করতে পারতাম?
না! এবার শব্দটি আর্তচিৎকারের মতো উচ্চারিত হলো। আমি তোমাকে আমার স্তনের দুধ পান করিয়েছি যখন তুমি শিশু ছিলে। আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে বাঁচিয়েছি যখন তোমার চাচা তোমাকে কামান দেগে মারতে চেয়েছিলো এবং কাবুলে তোমাকে বন্দুকের গুলি থেকে রক্ষা করেছি। আর সেই তুমিই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করে-তোমার আপন দুধভাইকে! আমি আমার কোলে একটা বিষাক্ত সাপ পুশেছি, একটা শয়তানকে পুশেছি।
মাহাম আঙ্গা মেঝের উপর গড়িয়ে পড়লেন, প্রথমে বিকারগ্রস্তের মতো নখ দিয়ে শতরঞ্জিতে আচড় কাটলেন এবং তারপর আকবরের হাঁটুর নিচের মাংসে নখ বসিয়ে আঁচড় দিলেন। আকবরের পা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে শতরঞ্জির লাল রঙের সঙ্গে মিশে যেতে লাগলো।
রক্ষী! আকবর নিজে তার গায়ে হাত দেয়ার কথা ভাবতে পারলেন না। তার সঙ্গে ভদ্র আচরণ করো। উনি শোকের আঘাতে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দুজন রক্ষী টেনে মাহাম আঙ্গাকে আকবরের কাছ থেকে সরিয়ে নিলো। এক মুহূর্ত পর তিনি মুক্ত হলেন কিন্তু পুনরায় আক্রমণের কোনো চেষ্ট করলেন না। শতরঞ্জির উপর বসে সামনে পিছনে দুলতে লাগলেন।
মাহাম আঙ্গা, আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, আপনার ছেলে যা করেছে সে সম্পর্কে কি আপনি জানতেন, আমাকে হত্যার চেষ্টা সম্পর্কে? তিনি তার অবিন্যাস্ত চুলের মধ্য দিয়ে আকবরের দিকে তাকালেন। না।
আর আপনি যে বৈরাম খানকে তীর্থ যাত্রায় পাঠানোর বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়ে ছিলেন, সেটা কি এই জন্য যে আমার উপর তার প্রভাবের জন্য আপনি এবং আদম খান তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন? এবারে মাহাম আঙ্গা নীরব রইলেন। আপনাকে উত্তর দিতেই হবে এবং দিতে হবে সভাবে। এটাই সম্ভবত আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
আমি ভেবেছিলাম বৈরাম খান না থাকলে তুমি অন্যদের কাছ থেকে উপদেশ নেবে।
যেমন আপনার কাছ থেকে এবং আপনার ছেলের কাছ থেকে?
হ্যাঁ। আদম খান আমাকে জানায় সে তোমার অবহেলার শিকার এবং আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করি।
আর আপনি কি বৈরাম খানকে হত্যার বিষয়েও তার সঙ্গে একমত হোন, যাতে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আর ফিরে আসতে না পারে? মাহাম আঙ্গার প্রতি তার কোমল অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও আকবর আবারও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠছিলেন। এই জিজ্ঞাসাবাদ যতো তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততোই সকলের জন্য মঙ্গল।
আকবরের কণ্ঠস্বরে তিক্ততার আভাস পেয়ে তাঁর দুধমা কিছুটা শঙ্কিত হলেন। আমি কখনোও চাইনি বৈরাম খান নিহত হোক….এবং আমি নিশ্চিত তার হত্যাকাণ্ডের জন্য আমার ছেলে দায়ি নয়, তোমাকে দম্ভ করে সে যাই বলে থাকুক না কেনো।
মায়ের ভালোবাসার মতো অন্ধ আর কিছুই নয়, আকবর ভাবলেন।
আমি সর্বদাই তোমাকে ভালোবেসেছি আকবর, মাহাম আঙ্গা নিপ্রভাবে বললেন, যেনো তিনি তার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন।
তা সত্যি, কিন্তু আপনি আপনার নিজের ছেলেকে তারচেয়েও বেশি ভালোবেসেছেন। মাহাম আঙ্গা, আমি এখন যা করতে যাচ্ছি তা এই রকম। আগামীকাল আপনাকে দিল্লীর দূর্গে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানে জীবনের বাকি দিন গুলি আপনি নির্বাসনে কাটাবেন। আপনার ছেলের জন্য একটি জাঁকজমকপূর্ণ সমাধি নির্মাণের জন্য আপনাকে আমি অর্থ প্রদান করবো। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের আর কোনো রকম সম্পর্ক থাকবে না। আকবর যখন মাহাম আঙ্গার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছেন তিনি শুনতে পেলেন সে পুনরায় বিলাপ শুরু করেছে। তাঁর অসংলগ্ন হাহাকার তখন আর শোক বাক্যের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি তখন আকবরের উপর ঈশ্বরের অভিশাপ বর্ষিত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করছেন এবং নিজ মৃত পুত্রের উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সেই সব যন্ত্রণাক্লিষ্ট শাপ শাপান্তের প্রতিধ্বনি পেছনে ফেলে আকবর ঘোর লাগা মানুষের মতো তার আপন মায়ের কক্ষের দিকে রওনা হলেন। গুলবদন হামিদার সঙ্গে ছিলেন এবং তাঁদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল ঘটনা সম্পর্কে তারা সবকিছু জানেন।
হামিদা আকবরকে বুকে জরিয়ে ধরে থাকলেন। আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তুমি নিরাপদে আছো। ঐ অকৃতজ্ঞ শয়তানটা কি করার চেষ্টা করেছিলো আমি শুনেছি…।
পাচিলের উপর থেকে নিচে ফেলে তাকে আমি হত্যা করেছি। আর মাহাম আঙ্গাকে দিল্লীর দূর্গে নির্বাসনে পাঠাচ্ছি।