আর বৈরাম খান?
তুমি কি মনে করো? আদম খানের বিধ্বস্ত মুখে এই মুহূর্তেও যেনো বিদ্রূপপূর্ণ বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো।
এটাই ওর জীবনের শেষ হাসি, আকবর নিজের অজ্ঞতা এবং বোকামীর জন্য নিজের উপরই তীব্র ক্রোধ অনুভব করে ভাবলেন।
রক্ষী ওকে নিয়ে প্রাচীরের উপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করো।
আকবরের সামনে দিয়ে দুজন রক্ষী আদম খানের পা টেনে উঠানের অপরপ্রান্তে ছেচড়ে নিয়ে গেলো, পাথরের মেঝেতে তার রক্তের লম্বা দাগ ফুটে উঠল। পাঁচিলের প্রান্তে পৌঁছে রক্ষীরা আদম খানের পা ছেড়ে দিয়ে তার বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে তাকে উপুর করলো, তারপর মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঠেলে বিশ ফুট নিচের চত্বরে ফেলে দিলো। রক্ষীরা ঝুঁকে নিচে পড়ে থাকা আদম খানকে পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর আকবরের দিকে ফিরে বললো, জাঁহাপনা সে এখনো নড়ছে।
তাহলে ওর চুল ধরে টেনে আবার উপরে নিয়ে এসো এবং আবার নিচে নিক্ষেপ করো।
রক্ষীরা সিঁড়ি বেয়ে চত্বরে নেমে গেলো এবং কয়েক মিনিট পরে আবার আবির্ভূত হলো আদম খানের খিচতে থাকা শরীরটার চুল ধরে টেনে। এবার আকবরও রক্ষীদের অনুসরণ করে পাঁচিলের ধারে উপস্থিত হলেন এবং আদম খানের দ্বিতীয় পতন প্রত্যক্ষ করলেন। এ যাত্রায় আদম খানের মাথার খুলির সঙ্গে পাথরের সরাসরি সংঘর্ষে তা বাদামের মতো ফেঁটে গেলো এবং মাথার গোলাপি-ধূসর মগজ ছিটকে পড়লো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আকাশ থেকে চিল নেমে এলো মৃতদেহটাকে ঠুকরে খাওয়ার জন্য। শীঘ্রই প্রায় একডজন চিল জুটে গেলো আকবরের বাল্যকালের সঙ্গীটির মৃতদেহ ভক্ষণ করার জন্য।
আকবর আর সেখানে দাঁড়ালেন না। সম্পূর্ণ ঘটনাটি তাঁর মনের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। তিনি এতো বোকামী করলেন কীভাবে? আবহাওয়া উষ্ণ হলেও তিনি ঠাণ্ডা অনুভব করলেন এবং কাঁপতে লাগলেন। একটা প্রশ্ন তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে প্রশ্নটি তিনি আদম খানকে করতে চেয়েও করেননি-হয়তো তিনি এর উত্তর কি হবে সে বিষয়ে শঙ্কিত ছিলেন। মাহাম আঙ্গা তার পুত্রের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কতটা জানেন? উঠানটিতে তখন ভিড় জমে গেছে। মেয়েরা তাদের ঘরং থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং হেরেম রক্ষীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অভাবিত ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছে। আমার জোব্বাটা এনে দাও, আকবর একজন পরিচারককে আদেশ দিলেন।
পনেরো মিনিট পর মনের মধ্যে একরাশ বিশৃঙ্খল ভাবনা নিয়ে আকবর। মাহাম আঙ্গার কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের তাঁর ঘর তল্লাশি করে ঘরের বাইরে পাহারায় থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। আদম খানের অর্ধমাতাল অবস্থা বিবেচনা করে অনুমান করা যায় সে একাই নিজস্ব আবেগের তাড়নায় উন্মত্ত আচরণ করেছে, যদিও তার ক্ষোভ এবং ঈর্ষা দীর্ঘদিন ধরে তার মাঝে পুঞ্জিভূত ছিলো। তা সত্ত্বেও আর কোনো বিশ্বাসঘাতক নিজের ঘরের মাঝে ওৎ পেতে আছে কিনা সেটা অনুসন্ধান করে দেখার এখনই উপযুক্ত সময় আকবরের জন্য। মাহাম আঙ্গার কক্ষের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আকবরের দেহরক্ষীদের অধিনায়ক তাকে সংক্ষিপ্ত অভিবাদন জানালো।
আমরা কক্ষটি তল্লাশি করেছি। এখানে প্রবেশ করা আপনার জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ জাহাপনা।
কি ঘটেছে সে সম্পর্কে দুধমাকে তোমরা কিছু বলেছে?
না জাহাপনা।
তিনি কি তার পুত্রের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেছেন?
না জাহাপনা।
আকবরের প্রবেশের জন্য যখন রক্ষীরা কক্ষের দরজা খুলে দিলো তিনি অনুভব করলেন, যে কাজ তিনি করতে যাচ্ছেন তা যে কোনো যুদ্ধের চেয়েও অধিক তিক্ততাপূর্ণ। রক্ষীদের অধিনায়কের বক্তব্য অনুযায়ী তার সঙ্গে আদম খানের লড়াই অথবা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মাহাম আঙ্গা কিছুই জানেন না, যদিও একজন ক্ষিপ্রগতির পরিচারকের মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগার কথা বার্তাটি মাহাম আঙ্গার কাছে পৌঁছানোর জন্য। মাহাম আঙ্গা তার কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার চেহারা উদ্বিগ্ন।
আকবর, এসব কি হচ্ছে? হঠাৎ করে কেনো আমার সঙ্গে কয়েদির মতো আচরণ করা হচ্ছে? আকবরের মুখের উপর নিবদ্ধ তাঁর বাদামি চোখ গুলিতে নির্ভেজাল বিস্ময়। নিজেকে শক্ত করার জন্য আকবর কয়েক মুহূর্ত আগা খানের রক্তাক্ত মৃতদেহটির কথা ভাবলেন, যা তিনি কয়েক মিনিট আগে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এখন তার দেহটি কর্পূর দিয়ে ধুয়ে সামাহিত করার প্রস্তুতি চলছে।
মাহাম আঙ্গা, সারা জীবন আমি আপনাকে আমার মায়ের মতো মনে করেছি। আমি যা বলতে যাচ্ছি তা বলা আমার জন্য মোটেই সহজ হবে, তাই আমি সরাসরি বলতে চাই। এক ঘন্টা আগে আপনার ছেলে আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক আতগা খানকে হত্যা করেছে এবং সে সশস্ত্র অবস্থায় বলপূর্বক হেরেমে ঢুকে পড়ে আমাকে হত্যা করার জন্য।
না! মাহাম আঙ্গা এমন কোমলভাবে শব্দটি উচ্চারণ করলেন যে তা প্রায় শুনাই গেলো না। নিজের অসার হয়ে আসা দেহের পতন ঠেকানোর জন্য তিনি অন্ধের মতো কিছু আকড়ে ধরতে চাইলেন অবলম্বন হিসেবে কিন্তু তার হাতে একটি মিষ্টির থালা ব্যতীত আর কিছু ঠেকলো না, থালাটি সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেলো।
এখানেই শেষ নয়। আদম খান আমাকে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের আহ্বান জানায় এবং আমি তাকে ন্যায্যভাবে লড়াই-এ পরাজিত করি। তারপর আমি আদেশ করি তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মৃত্যুদন্ড প্রদানের জন্য।